ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেনঃ-
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْراً فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَ قَاتِلُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ کَآفّة کَمَا یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ کَآفّةً وَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ (التوبة/٣٦)
অর্থাৎঃ-নিশ্চয় আছমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের উপর যুল্ম করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ করো সমবেতভাবে, যেমন তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাক্বীগণের সাথে রয়েছেন। (ছূরা আত্তাওবাহ-৩৬)
এ চারটি নিষিদ্ধ মাস সম্পর্কে আবূ বাকরাহ 3 থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-
الزَّمَانُ قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ثَلَاثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ
অর্থঃ- আল্লাহ 7 আকাশ ও পৃথিবীকে যেদিন সৃষ্টি করেছিলেন সেদিন সময়ের যে আকার ছিল, অদ্য (হাজ্জাতুল ওয়িদা‘ বা বিদায় হাজ্বের দিন)সময় তার সেই মূল আকারে (মূল অবস্থা ও গণনায়) ফিরে এসেছে। বৎসর হলো বারো মাসে। তন্মধ্যে চারটি হলো নিষিদ্ধ। তিনটি পরপর একনাগাড়ে, সেগুলো হলো যুল কা‘দাহ, যুলা হিজ্জাহ ও মুহার্রাম এবং আরেকটি হলো-‘‘রাজাবু মুযার’’ যেটি জুমাদা ও শা‘বান এ দু’টি মাসের মধ্যবর্তী। (রাজাবু রাবী‘আহ বা রাবী‘আহ গোত্রের নিকট যেটি রাজাব মাস হিসেবে পরিচিত সেটা নয়। তারা মূলত আমাদের নিকট রামাযান হিসেবে পরিচিত যে মাসটি সেটিকে রাজাব ও নিষিদ্ধ মাস হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছিল)। {সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুছলিম}
এই চারটি মাসকে আশহুরুল হুরুম বা নিষিদ্ধ মাস বলে অভিহিত করার দু’টি কারণ রয়েছে।
(এক) জাহিলী যুগে অধিকাংশ ‘আরবগণ এই চারটি মাসকে সম্মান করত এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুন খারাবির জন্য নিষিদ্ধ গণ্য করত। তারা এ মাসগুলোতে খুন খারাবি ও যুদ্ধে লিপ্ত হত না। ইছলাম এই ধারাকে অব্যাহত রাখে এবং এটিকে আরো সুসংহত করে। বিশেষ করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিরাপদে এসে মানুষ যাতে শান্তিতে হাজ্ব-‘উমরাহ পালন করতে পারে, তাই এ মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়।
মানুষ যাতে শান্তিতে হাজ্বের প্রস্তুতি নিতে পারে এবং নিরাপদে হাজ্বের ছফর সম্পন্ন করতে পারে তজ্জন্য যুল হিজ্জাহ এর পূর্ববর্তী মাস অর্থাৎ যুল কা‘দাহ মাসকে নিষিদ্ধ করা হয়। শান্তি ও নিরাপদে হাজ্ব-‘উমরাহ সম্পাদনের জন্য যুল হিজ্জাহ মাসকে এবং হাজ্ব-‘উমরাহ সম্পাদনকারীগণ যাতে শান্তি ও নিরাপদে নিজ নিজ গন্তব্যে পুনরায় ফিরে যেতে পারে, তজ্জন্য হাজ্বের পরবর্তী মাস অর্থাৎ মুহার্রাম মাসকে নিষিদ্ধ করা হয়। রাজাব মাসকে আলাদাভাবে নিষিদ্ধ করার কারণ হলো মানুষ যাতে ঐ মাসে নিরাপদ ও শান্তিতে ‘উমরাহ সম্পাদন করতে পারে।
নিষিদ্ধ মাসগুলোর মধ্যে রাজাব এর অবস্থান অপর তিনটি মাস থেকে পৃথক বা স্বতন্ত্র হওয়ার কারণে এ মাসকে “রাজাবুল ফার্দ” বা একা মাস ও বলা হয়।
এ মাসটিকে “রাজাবু মুযার” ও বলা হয়। কেননা প্রাক ইছলামী যুগ থেকেই মুযার গোত্রের লোকেরা এ মাসটিকে নিষিদ্ধ মাস বলে গণ্য করত এবং এটিকে সম্মানিত মাস বলে বিশ্বাস করত।
উপরোক্ত চারটি মাসে আক্রমনাত্মক যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ (ইছলামের এই বিধান পরবর্তীতে রহিত বা মানছূখ হয়েছে কি না, এবিষয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। তবে এমাসে কিংবা নিষিদ্ধ যেকোন মাসে প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ নিষিদ্ধ নয়, এবং এ বিষয়ে ‘উলামায়ে কিরামের কারো কোন দ্বীমত নেই)।
(দুই) অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসগুলোতে পাপ ও হারাম কাজ করা আরো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
যেহেতু দাঙ্গা, যুদ্ধ-মারামারি ও পাপকাজগুলোকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়ে আল্লাহ 7 এ মাসগুলোর সম্মান রক্ষা করেছেন, তাই এই অর্থে এগুলো সম্মাণিত মাসও বটে।
জাহেলী যুগে ‘আরবরা এই নিষিদ্ধ মাসগুলোকে নিজেদের ইচ্ছেমত পিছিয়ে নিত, যাতে করে তারা নিজেদের সুবিধামত লড়াই বা যুদ্ধ করতে পারে। এভাবে প্রতিবছর তারা এ মাসগুলোকে এমনভাবে পিছাত যাতে করে বছরের বারো মাসের সবগুলো মাসেই যেন একবার করে যুল কা‘দাহ, যুলা হিজ্জাহ ও মুহার্রাম মাস পড়ে। যেমন, কোন বছর তারা সফরকে, কোন বছর রাবী‘উল আউয়াল মাসকে 5 কোন বছর রামাযান মাসকে, কোন বছর শাওয়াল মাসকে এভাবে প্রতিবছর তারা নিজেদের সুবিধামত নতুন এক একটি মাসকে যুল কা‘দাহ, যুল হিজ্জাহ, মুহার্রাম ও রাজাব মাস বলে নির্ধারণ করত। আর এভাবে মানুষের কাছে মুহার্রাম, রাজাবও যুল কা‘দাহ এর ন্যায় যুল হিজ্জাহ মাসটিও তার প্রকৃত সময় ও অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল। রাছূলুল্লাহ 1 যে বৎসর বিদায় হাজ্ব সম্পাদন করেন সেই বৎসরই যুল হিজ্জাহ মাসটি তার সেই প্রকৃত সময় ও অবস্থানে ফিরে আসে, যে সময় ও অবস্থানে আল্লাহ 7 এ মাসটিকে রেখেছিলেন আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির সূচনালগ্নে। আবূ বাকরাহ 3 বর্ণিত উপরোক্ত হাদীছে রাছূলুল্লাহ 1 এ কথাটিই বলেছেন।
প্রত্যেক মুছলিমের জেনে রাখা উচিত যে, ‘আরবী মাসের গণনা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। তাই নিজেদের স্বার্থে কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে চন্দ্র মাসকে (‘আরবী মাস) কিংবা চন্দ্র মাসের কোন দিনকে হেরফের বা আগ পিছু করার অধিকার কারো নেই। এরূপ করা ইছলামে হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ।
দুঃখের বিষয়! এই নিষিদ্ধ ও সম্মাণিত মাসগুলোতে আল্লাহ 0 আমাদেরকে যেসব কাজ করতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন (পাপ ও সীমালঙ্ঘন মূলক কাজের), আমাদের মুছলিম সমাজ সেসব বিষয়ে সম্পূর্ণ বেখবর ও উদাসীন। শুধু তাই নয় বরং পরিসংখ্যানে দেখা যাবে যে, সেই সব নিষিদ্ধ কাজ এ মাসগুলোতে মুছলমানরা আরো বেশি করছে।
এ মাসগুলোতে মুছলমানরা বেশি বেশি পাপ ও সীমালঙ্ঘন মূলক কাজের মাধ্যমে নিজেদের উপর আরো বেশি যুল্ম করছে।
অপরদিকে এসব মাসে যে সকল কাজ করার নির্দেশ ক্বোরআন বা ছুন্নাহ্র কোথাও নেই, মুছলিম সমাজ সেসকল কাজকে আল্লাহ্র আনুগত্যমূলক কাজ বা ‘ইবাদাত মনে করে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করছে। আর এরকম একটি কাজ হলো-২৭শে রাজাবের রাত্রিকে শবে মি‘রাজ বা 1 এর মি‘রাজের (উর্দ্ধাকাশে যাওয়ার) রাত সাব্যস্ত করে সেই রাতকে বিশেষভাবে ‘ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যে উদযাপন করা এবং পরের দিন সিয়াম বা রোযা পালন করা।
আমাদেরকে অবশ্যই একথা বিশ্বাস ও স্বীকার করতে হবে যে, লাইলাতুল ইছরা ওয়াল মি‘রাজ হলো আল্লাহ্র (0) সুমহান নিদর্শন সমূহের একটি। ইছরা ও মি‘রাজের ঘটনাটি একদিকে যেমন আল্লাহ্র (0) মহান ক্বোদরাতের এক বিষ্ময়কর বহিঃপ্রকাশ, তেমনি তা রাছূলুল্লাহ 1-র নাবুওয়্যাত ও রিছালাতের সত্যতার এক জলন্ত প্রমাণ। ইছরা ও মি‘রাজের ঘটনা দ্বারা অকাট্যভাবে এ বিষয়টিও প্রমাণিত যে, আল্লাহ্র (0)অবস্থান হলো সমগ্র সৃষ্টি জগতের উর্দ্ধে ‘আর্শে ‘আযীমের উপরে। আর তাঁর জ্ঞান ও শক্তি হলো সর্বব্যাপী-সর্বত্র। সমগ্র সৃষ্টি জগতের সকল কিছু তাঁর পরিপূর্ণ ‘ইল্ম (জ্ঞান) ও ক্বোদরাতের (মহান শক্তির) সম্পূর্ন আওতাধীন।
ক্বোরআনে কারীমে ছূরাতুল ইছরার শুরুতেই এ ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ 7 ইরশাদ করেছেনঃ-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ. (الإسراء–۱)
অর্থাৎঃ- পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাহ্কে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বারাকাহ দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ।(ছূরা আল-ইছরা-১)
রাছূলুল্লাহ (1) থেকে ধারাবাহিক একাধিক বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে যে, মি‘রাজের রাতে তাঁকে নিয়ে জিবরীল 5 ঊর্দ্ধাকাশে গমণ করেন। তাঁর জন্য (রাছূলুল্লাহ 1 এর জন্যে) আকাশের দরজা খূলে দেয়া হয়। এভাবে এক এক করে তিনি সপ্ত আকাশ অতিক্রম করেন। আর সেখানেই (সপ্তম আকাশের ঊর্দ্ধে) আল্লাহ 0 তাঁর নাবী মোহাম্মাদ 1-র সাথে সরাসরি কথা বলেন। সেখানেই আল্লাহ 0 সর্বশেষ নাবী মোহাম্মাদ 1 ও তাঁর উম্মাতের প্রতি পাঁচ ওয়াক্বত সালাত ফার্য করে দেন। যদিও শুরুতে আল্লাহ 7 পঞ্চাশ ওয়াক্ব্ত সালাত ফার্য করেছিলেন, কিন্তু মি‘রাজ থেকে ফিরে আসার আগেই মূছা 5 এর পরামর্শক্রমে রাছূলুল্লাহ 1 পরপর পাঁচ দফা মহান আল্লাহ্র কাছে আকুতি জানালে আল্লাহ 0 স্বীয় অপার অনুগ্রহে পঞ্চাশ ওয়াক্ব্ত সালাতকে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ব্ত ফার্য নির্ধারণ করে দেন। সংখ্যার দিক থেকে যদিও আল্লাহ 7 পঞ্চাশ ওয়াক্বত্কে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্বত নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তবে মর্যাদার দিক থেকে এই পাঁচ ওয়াক্ব্তকেই পঞ্চাশ ওয়াক্বতের মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন। এটা ছিল মোহাম্মাদ 1-র উম্মাতের প্রতি আল্লাহ্র (0) এক বিশেষ অনুগ্রহ ও অনুকম্পা- ফালিল্লাহিল হাম্দ।
ইছরা ও মি‘রাজের এ মহান রাতটি যদিও অত্যন্ত মর্যাদা ও তাৎপর্যপূর্ণ, তবে এ রাতকে কেন্দ্র করে দ্বীনী বিশেষ কোন আচার-অনুষ্ঠান, ‘ইবাদাত-বন্দেগী করার বিধান বা সুযোগ ইছলামে নেই। এর কারণ হলোঃ-
(এক) যে রাতে ইছরা ও মি‘রাজের ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি কোন মাসের কত তারিখ ছিল, এ বিষয়ে বিশুদ্ধ কোন হাদীছ যেমন বর্ণিত নেই, তেমনি সুনির্দিষ্টভাবে এতদবিষয়ে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য বা খবর ও বর্ণিত নেই।
কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায়, এমহান ঘটনাটি (ইছরা ও মি‘রাজের ঘটনাটি) রাছূলুল্লাহ 1-র নাবুওয়্যাত লাভের পনেরো (১৫) মাস পর মুহার্রাম মাসে, কেউ বলেছেন মাদীনায় হিজরাতের এক বৎসর পূর্বে রাবী‘উল আউয়াল মাসের ২৭ তারিখ রাতে, কেউ বলেছেন নাবুওয়্যাত লাভের পাঁচ বৎসর পর রামাযান মাসে, আর কেউ বলেছেন রাবী‘উছ্ ছানী মাসের ২৭ তারিখ রাতে সংঘটিত হয়েছিল।
ইমাম আবূ শামাহ (o) বলেছেনঃ-“কিছুসংখ্যক গল্পকার থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ইছরা ও মি‘রাজের ঘটনাটি রাজাব মাসে সংঘটিত হয়েছিল। অথচ ‘ইলমুর্ রিজাল ও ছানাদসূত্র বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা।
ইমাম ইবনু ক্বায়্যিম আল জাওযিয়্যাহ (o) বলেছেনঃ- “ইছরা ও মি‘রাজের রাত কোনটি ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা যায়নি”।
সুতরাং যেখানে রাজাব মাসেই শবে মি‘রাজ হওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ২৭শে রাজাবের রাতকে কি করে শবে মি‘রাজ সাব্যস্ত করা যেতে পারে?!
‘আল্লামা ‘আব্দুল ‘আযীয ইবনু বায (o) বলেছেনঃ-“ইছরা ও মি‘রাজের ঘটনা রাজাব মাসে, না কি অন্য কোন মাসে সংঘটিত হয়েছিল, বিশুদ্ধ কোন হাদীছে এ বিষয়ে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। আর যেসব বর্ণনায় সুনির্দিষ্টভাবে এর মাস ও তারিখ উল্লেখ রয়েছে, সেগুলো রাছূলুল্লাহ 1 থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে আদৌ বর্ণিত নয়”।
মানুষকে এই মহান ঘটনার সুনির্দিষ্ট তারিখটি ভুলিয়ে দেয়ার পিছনে অবশ্যই আল্লাহ্র (7) মহান কোন হিকমাহ রয়েছে। নতুবা এত বড় ঘটনার তারিখ অসংখ্য সাহাবায়ে কিরামের (g) জানা থাকার কথা ছিল এবং অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদীছের ন্যায় এটিও তাঁদের (সাহাবায়ে কিরাম-g) থেকে একাধিক বিশুদ্ধ ধারাবাহিক ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত থাকার কথা ছিল। অতএব রাজাব মাস সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে এই বিশ্বাস পোষণ করা যাবে না যে, এটি ইছরা বা মি‘রাজের মাস এবং ২৭শে রাজাব সম্পর্কে অবশ্যই এই বিশ্বাস পোষণ করা যাবে না যে, এটি শবে মি‘রাজ বা মি‘রাজের রাত।
(দুই) রাছূলুল্লাহ 1, সাহাবায়ে কিরাম (g), তাবি‘ঈন কিংবা তাব‘য়ে তা্বি‘ঈনের কেউ ইছরা ও মি‘রাজের রাতে বিশেষভাবে (অধিক ছাওয়াব বা ফাযীলাত লাভের আশায়) কোন ‘ইবাদাত-বন্দেগী করেছেন কিংবা পরদিন সিয়াম পালন করেছেন মর্মে বিশুদ্ধ বা গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। যদি তা ছাওয়াবের কাজ বা দ্বীনে ইছলামের অন্তর্ভুক্ত কাজ হতো, তাহলে অবশ্যই সর্বাগ্রে রাছূলুল্লাহ 1 নিজে এসব কাজ করতেন এবং স্বীয় উম্মাতকে এই রাত ও দিনটিকে বিশেষভাবে ‘ইবাদাত-বন্দেগী ও সিয়াম পালনের মাধ্যমে উদযাপনের নির্দেশ দিয়ে যেতেন। আর যদি রাছূলুল্লাহ 1 এমনটি বলে থাকতেন বা করে থাকতেন তাহলে অবশ্যই বিষয়টি গোপন থাকত না বরং বহুসংখ্যক সাহাবায়ে কিরামের (g) তা জানা থাকত। তাঁরা নিজেরা সেটি পালন করতেন এবং অবশ্যই এ বার্তাটি অন্যদের নিকটও যথাযথভাবে পৌছে দিতেন। যেমনটি তারা করেছেন দ্বীনের অন্যান্য প্রতিটি বিষয়ে।
শাইখুল ইছলাম ইবনু তাইমিয়াহ (o) বলেছেনঃ- “রাজাব মাসে বিশেষভাবে (অধিক মর্যাদা ও ছাওয়াব লাভের আশায়) সিয়াম পালন সম্পর্কিত যেসব হাদীছ বর্ণিত রয়েছে সেসবই দুর্বল, মিথ্যা ও বানোয়াট। ‘উলামায়ে কিরামের নিকট ঐসব বর্ণনার একটিও নির্ভরযোগ্য নয়। দুর্বল বর্ণনাগুলো এমন পর্যায়ের যে, সেগুলো ফাযাইল বর্ণনার ক্ষেত্রেও অনুপযুক্ত। মুছনাদ ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে নিষিদ্ধ মাসগুলোতে সিয়াম পালনের বিষয়ে রাছূলুল্লাহ 1 থেকে যে নির্দেশ পাওয়া যায়, সেগুলো মূলতঃ নিষিদ্ধ চারটি মাসের সবগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বিশেষভাবে কোন একটি মাস কিংবা কেবল রাজাব মাসের জন্য প্রযোজ্য নয়”। (মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া লি শাইখিল ইছলাম ইবনু তাইমিয়াহ, ২৫/২৯০)
ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম আল জাওযিয়্যাহ (o) বলেছেনঃ- “রাজাব মাসের সিয়াম সিম্পর্কে কিংবা রাজাব মাসের বিশেষ কিছু রাতে নফল সালাত পড়া সম্পর্কে যেসব হাদীছ রয়েছে সেগুলো সবই মিথ্যা ও বানোয়াট”। (আল-মানার আল-মুনীফ-লিল ইমাম ইবনু ক্বায়্যিম আল যাওজিয়্যাহ পৃষ্ঠা-৯৬)
হাফিয ইবনু হাজার আল ‘আছক্বালানী (o) বলেছেনঃ- “রাজাব মাসের ফযীলত বা মর্যাদা সম্পর্কে, এবং এ মাসে বা এ মাসের বিশেষ কোন দিনে সিয়াম পালন সম্পর্কে কিংবা এ মাসের বিশেষ কোন রাতে নফল সালাত সম্পাদন সম্পর্কে প্রমাণ উপযোগী বিশুদ্ধ কোন হাদীছ বর্ণিত নেই”। (তাবঈনুল ‘আজাব বিমা অরাদা ফী ফাযলি রাজাব-পৃষ্ঠা নং ১১)
রাজাব মাসের ২৭ তারিখে সিয়াম পালনের বিধান সম্পর্কে শাইখ আল ‘আল্লামা মোহাম্মাদ ইবনু সালেহ আল‘উছাইমীন o-কে জিজ্ঞেস করা হলে প্রতি উত্তরে তিনি বলেনঃ- “২৭শে রাজাব বিশেষভাবে (তাতে বিশেষ ফাযীলত বা ছাওয়াব রয়েছে মনে করে) সিয়াম পালন করা এবং ঐরাতে বিশেষভাবে নফল সালাত সম্পাদন করা হলো বিদ‘আত”।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাছাইল- ফাযীলতুশ্ শাইখ মোহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল ‘উছাইমীন, ২০/৪৪০)
অনেকেই রাজাব মাসের প্রথম শুক্রবার রাত্রিতে ‘‘সালাতুর্ রাগায়িব” নামক বিশেষ একপ্রকার নফল সালাত পড়ে থাকেন। অথচ এটি একটি বিদ‘আত। দ্বীনে ইছলামে এর কোন ভিত্তি নেই এবং এটি কোনভাবেই দ্বীনে ইছলামের অন্তর্ভুক্ত কোন কাজ নয়।
জাহিলী যুগের লোকেরা এ মাসে ‘আতীরাহ নামক বিশেষ একপ্রকার ক্বোরবানী প্রদান করত। ইছলাম আগমনের পর রাছূলুল্লাহ 1 এপ্রথাটিকে বাতিল ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আবূ হুরাইরাহ রাযিয়াল্লাহ ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-
لا فَرَعَ ولا عَتِيرَةَ. (متفق عليه)
অর্থাৎঃ- ফারা‘ বা ‘আতীরাহ বলতে কিছু নেই। (সাহীহ বুখারী)
(ফারা‘ হলো-গবাদী পশুর প্রথম জন্ম দেয়া বাচ্চা, যেটিকে কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী অর্থাৎ বাতিল উপাস্যদের উদ্দেশ্যে যবেহ করত।
আর জাহিলী যুগের লোকেরা রাজাব মাসে বিশেষভাবে যে পশুটি ক্বোরবানী করত সেটিকে তারা ‘আতীরাহ বা রাজাবিয়্যাহ নামে অভিহিত করত)
সুতরাং রাজাব মাসে কিংবা ২৭শে রাজাব বিশেষ ফাযীলাত ও অধিক ছাওয়াব লাভের আশায় সালাত, সিয়াম, দো‘আ, যিক্র, ক্বোরবানী, সাদাক্বাহ ইত্যাদি বিশেষ কোন ‘ইবাদাত –বন্দেগী করা বিদ‘আত ও ইছলামে নিষিদ্ধ। তাই এসব কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
তবে কারো যদি প্রতিমাসে নফল সিয়াম পালন কিংবা প্রায়শ রাতে নফল সালাত, দো‘আ, যিক্র, তিলাওয়াতুল ক্বোরআন ইত্যাদি ‘ইবাদাত-বন্দেগী করার অভ্যাস থাকে কিংবা মাঝে-মধ্যে নিজের সামর্থ অনুযায়ী পশু ক্বোরবানী দেয়ার বা কোনরূপ সাদাক্বাহ করার অভ্যাস থাকে, তাহলে তিনি স্বভাব সুলভ ও স্বাভাবিকভাবে এসব ‘ইবাদাত-বন্দেগী করতে পারবেন এবং তদ্বারা তিনি অবশ্যই আল্লাহ্র কাছে উত্তম প্রতিদান বা ছাওয়াব লাভের আশা করতে পারেন।
যেহেতু রাজাব মাস সহ অন্য তিনটি নিষিদ্ধ মাস সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অন্যতম একটি নির্দেশ হলোঃ-
فَلا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ.
অর্থাৎঃ-সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের উপর যুল্ম করো না।(ছূরা আত্তাওবাহ-৩৬)
এআয়াত দ্বারা স্পষ্টত বোঝা যায় যে, পাপ ও সীমালঙ্ঘন মূলক কাজ যদিও সবসময়ই নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় তথাপি এই মাসগুলোতে এসব কাজ আরো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও বর্জনীয়।
তাই এ মাসগুলোতে বিশেষ করে রাজাব মাসে প্রত্যেক মুছলমানের মূল করণীয় হলো সর্বপ্রকার পাপ ও সীমালঙ্ঘন মূলক কাজ সম্পূর্নরূপে পরিহার করে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আসন্ন মাহে রামাযানে পরিপূর্ন ঈমান ও ইহতিছাবের সাথে সিয়াম পালনের যোগ্য করে গড়ে তোলা।
রাজাব মাসে বিশেষভাবে ‘উমরাহ পালন করা যাবে কি না, এ বিষয়ে ‘উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। ‘উমরাহ সাধারণত বছরের যে কোন মাসেই পালন করা যায়। তবে রামাযান মাসে ‘উমরাহ পালনের বিশেষ মর্যাদা বা ফাযীলাত রয়েছে, এ বিষয়ে কারো কোন দ্বীমত নেই। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাছ (h) থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-
(عُمرَةٌ في رمَضَانَ تَعدِلُ حجة أَوْ حَجَّةً مَعِي (متفقٌ عليهِ
অর্থাৎঃ- রামাযান মাসে ‘উমরাহ পালন একটি হাজ্ব বা আমার সাথে হাজ্ব পালনের সমান (ছাওয়াব)। {সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুছলিম}
রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালনের বিশেষ কোন ফাযীলত রয়েছে কি না, এ বিষয়ে মতভিন্নতার কারণ হলো- ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার(h) থেকে বর্ণিত হাদীছঃ-
أن النبي ﷺ اعتمر في رجب
অর্থঃ-রাছূলুল্লাহ 1 রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করেছেন।(সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুছলিম)
আবার ঐ একই হাদীছের শেষাংশে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ f ইবনু ‘উমার (h) এর একথা শুনার পর বলেছেনঃ-
يرحم الله أبا عبد الرحمن، ما اعتمر عمرة، إلا وهو شاهده، وما اعتمر في رجب قط
অর্থঃ-“আল্লাহ আবূ ‘আব্দুর্ রাহমানের (ইবনু ‘উমারের) প্রতি দয়া করুন! রাছূলুল্লাহ 1 এর এমন একটি ‘উমরাহও নেই যেখানে ইবনু ‘উমার (h) অনুপস্থিত ছিলেন।(অর্থাৎ-রাছুলুল্লাহ 1 প্রতিটি ‘উমরাহকালীন সময়ে ইবনু ‘উমার উপস্থিত ছিলেন) অথচ রাছূলুল্লাহ 1 কখনো রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করেননি”। (অর্থাৎ বিষয়টিতে ইবনু ‘উমার h এর স্মৃতি বিভ্রম হয়েছে-আল্লাহ তাঁকে রহম করুন) {সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুছলিম}
‘আয়িশাহ f এর একথা শুনার পর ইবনু ‘উমার (h) কোনরূপ প্রতিবাদ করেছেন মর্মে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
এ কারণে ‘উলামা ও মুহাদ্দিছীনে কিরামের অধিকাংশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রাছূলুল্লাহ 1 রাজাব মাসে কোন ‘উমরাহ পালন করেননি। অথচ তিনি তাঁর জীবদ্দশায় মোট চারটি ‘উমরাহ পালন করেছিলেন এবং সবক’টি যুল কা‘দাহ মাসে। অতএব রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালনে বিশেষ কোন ফাযীলাত রয়েছে বলে দাবী করা যাবে না।
অপরদিকে ইমাম বাইহাক্বী (o) তাঁর ছুনান গ্রন্থে ‘আয়িশাহ f সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (‘আয়িশাহ f) রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করতেন।
ত্বাবাক্বাতে ইবনু ছা‘আদ- এ ইবনু ‘উমার 3 সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি (ইবনু ‘উমার 3) রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করতেন।
হাফিয ইবনু রাজাব (o)তাঁর আল্ লাত্বায়িফ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘উমার 3 রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করতে পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেছেন যে, ‘আয়িশাহ f এবং ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার h এবং ছালাফগণ রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করতেন।
ইমাম ইবনু ছীরীন রাহিমাহুল্লাহ থেকেও বর্ণিত রয়েছে যে, ছালাফগণ (রিযওআনুল্লাহি ‘আলাইহিম আযমা‘য়ীন) রাজাব মাসে ‘উমরাহ সম্পাদন করতেন।
সর্বোপরী এ বিষয়ে সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুছলিমে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (h) থেকে বর্ণিত হাদীছঃ-
أن النبي ﷺ اعتمر في رجب
অর্থঃ- রাছূলুল্লাহ 1 রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করেছেন।
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে আয়িম্যায়ে কিরামের অনেকের অভিমত হলো- ফাযীলাত লাভের আশায় রাজাব
মাসে ‘উমরাহ পালন করা যাবে এবং এ কাজটিকে কোনভাবে বিদ‘আত বলা যাবে না।
‘আয়িশাহ f–র বক্তব্য সম্পর্কে তাদের কথা হলোঃ- হাদীছের ‘উসূল (মূলনীতি)অনুযায়ী হ্যাঁ অর্থাৎ ইতিবাচক বর্ণনা, না বা নেতিবাচক বর্ণনার উপরে প্রাধান্য পাওয়ার দাবী রাখে, বিশেষ করে যখন ইতিবাচক বর্ণনার বর্ণনাকারী সুপ্রসিদ্ধ ও বিশ্বস্ত লোক হয়ে থাকেন।
যেহেতু ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (h) একজন সুপ্রসিদ্ধ সাহাবী ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী ছিলেন, তাই তার ইতিবাচক বর্ণনাটি ‘আয়িশাহ f-র নেতিবাচক বর্ণনার উপর প্রাধান্য পাবে।
এছাড়া এটাও তো হতে পারে যে, রাছূলুল্লাহ 1 রাজাব মাসে ‘উমরাহ পালন করেছেন কিন্তু বিষয়টি ‘আয়িশাহ-র (f) জানা ছিল না। এরকমতো আরো অনেক ছুন্নাহ ছিল, যেগুলো সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রিযওআনুল্লাহি ‘আলাইহিম আযমা‘য়ীন) জানতেন কিন্তু ‘আয়িশাহ (f) জানতেন না। অনুরূপ, এমন কিছু ছুন্নাহ ছিল যে সম্পর্কে ‘আয়িশাহ (f) জানতেন কিন্তু অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (g) জানতেন না।
(তিন) আল্লাহ 7 দ্বীনে ইছলামকে পরিপূর্ণ ও সম্পন্ন করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেনঃ-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا .( المائدة :٣)
অর্থাৎঃ- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নি‘মাহ সম্পন্ন করে দিলাম এবং ইছলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম। (ছূরা আল মা-ইদাহ,৩)
যেহেতু রাছূলুল্লাহ 1 পবিত্র জীবদ্দশায়ই দ্বীনে ইছলাম পরিপূর্ণ ও পরিসমাপ্ত হয়ে গেছে, তাই রাছূলুল্লাহ 1 মৃত্যুর পর ক্বিয়ামত পর্যন্ত দ্বীনী কাজ বা ‘ইবাদাত ও ছাওয়াবের কাজ বলে নতুন কিছু দ্বীনে ইছলামে অন্তর্ভুক্ত বা সংযোজন করার আদৌ কোন অধিকার বা সুযোগ কারো নেই।
ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেনঃ-
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ. ( الشورى :۲۱)
অর্থাৎঃ-তাদের কি এমনসব শরীক আছে,যারা তাদের জন্যে দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবর্তন করে দেয়, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? যদি চুড়ান্ত সিন্ধান্ত না থাকত, তবে তাদের ব্যাপারে ফয়সালা হয়ে যেত। নিশ্চয় যালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (ছূরা আশ্শুরা-২১)
এ আয়াত দ্বারা একথাটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, দ্বীনের মধ্যে কোন কিছু প্রবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজনের অধিকার একমাত্র আল্লাহ 0 ব্যতীত আর কারো নেই। কেউ যদি ‘ইবাদাত বা ছাওয়াবের কাজ বলে দ্বীনে ইছলামের মধ্যে এমনকিছু প্রবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন করতে চায়, যা করার অনুমতি 0 দেননি কিংবা রাছূলুল্লাহ 1 করেননি, তাহলে অবশ্যই সেটা প্রত্যাখ্যাত হবে, কোনভাবেই তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد.(متفق عليه)
অর্থাৎঃ-যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নেই, এমনকিছু তাতে নতুন উদ্ভাবন করবে তাহলে সেটা হবে প্রত্যাখ্যাত। (সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুছলিম)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-
من عمل عملا ما ليس منه فهو رد. (صحيح مسلم)
অর্থাৎঃ-যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যা আমাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে সেটা হবে প্রত্যাখ্যাত। (সাহীহ মুছলিম)
‘ইবাদাত বা ছাওয়াবের কাজ মনে করে ক্বোরআন ও ছুন্নাহ্তে নেই এমন কোন কাজ করার অর্থ হলো-দ্বীনের মধ্যে কোনকিছু সংযোজন বা বৃদ্ধি করা, যা প্রকৃতপক্ষে দ্বীনে ইছলামকে অসম্পূর্ন বা ত্রুটিপূর্ণ ঘোষণা করার নামান্তর। তাছাড়া দ্বীনের মধ্যে নিজেদের খেয়াল-খুশি মত কোনকিছু সংযোজন বা বিয়োজন, এটা হলো প্রকৃতপক্ষে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের স্বভাব-বৈশিষ্ট।
তাই প্রত্যেক মুছলিমের জন্য ওয়াজিব, দ্বীনে ইছলামের মধ্যে সব ধরনের বিদ‘আত থেকে নিজে দূরে থাকা এবং অন্যদেরকেও তা থেকে সতর্ক ও সাবধান করা। ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 7 ইরশাদ করেছেনঃ-
(وَالْعَصْرِ . إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ . إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ. وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (العصر
অর্থাৎঃ- কালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে আছে। তবে তারা নয় যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম সমূহ করে, পরস্পরকে সত্যের সদুপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেয়। (ছূরা আল ‘আস্র)
রাছূলুল্লাহ 1 প্রায়শই তাঁর খুতবাহ্তে বলতেনঃ –
(فإن خير الحديث كتاب الله، وخير الهدي هدي محمد 1 وشر الأمور محدثاتها، وكل بدعة ضلالة. (أخرجه مسلم
অর্থঃ-নিশ্চয় সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহ্র কিতাব(আল ক্বোরআনুল কারীম) আর সর্বোত্তম পথনির্দেশ হলো রাছূলুল্লাহ-র (1) প্রদর্শিত পথ, এবং নিকৃষ্ট বিষয়াদী হলো (দ্বীনের মধ্যে) নবআবিস্কৃত বিষয়াদী আর প্রতিটি বিদ‘আত (নবআবিস্কৃত) বিষয় হলো পথভ্রষ্টতা। (সাহীহ মুছলিম)
প্রত্যেক মুছলমানের অবশ্য করণীয় হলো ক্বোরআন ও ছুন্নাহ্কে যথাযথভাবে অনুসরণ করা, এর উপর অবিচল বা দৃঢ়পদ থাকা এবং সাহাবায়ে কিরাম, তাবি‘য়ীন ও তাবয়ে তাবি‘য়ীন (রিযওআনুল্লাহি ‘আলাইহিম আযমা‘য়ীন) যেভাবে যেসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন, সেভাবে সেসব কাজ সম্পাদন করা এবং যেসব কাজ বর্জনের মাধ্যমে তারা আল্লাহ্র ক্রোধ, ‘আযাব ও গযব থেকে বেঁচে থাকতে সচেষ্ট ছিলেন, সেসব কাজ থেকে বিরত থাকা। নাজাত বা মুক্তি এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের এটাই হলো সহজ-সরল ও সঠিক উপায়।
আল্লাহ 0 আমাদের সকলকে এ পথ অনুসরণ করে চলার তাওফীক্ব দান করুন। আ-মী-ন।
সংকলনেঃ- ইত্তিলা‘ ডেস্ক
সূত্রঃ-
১। আত্তাহযীর মিনাল বিদা‘-লিল ‘আল্লামা ‘আব্দিল ‘আযীয ইবনু বায (o)
২। মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুশ্ শাইখ ইবনু বায (o)। ভলিয়ম নং ১১)
৩। মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাছাইল-ফাযীলতুশ্ শাইখ মোহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল
‘উছাইমীন (o)।
৪। তাবঈনুল ‘আজাব বিমা অরাদা ফী ফাযলি রাজাব লিল হাফিয ইবনু হাজার
আল ‘আছক্বালানী (o)।