ড. আশ্‌ শাইখ সালিহ্‌ আল ফাওযান কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত ইমাম আল বারবাহারী রচিত “শারহুছ্ ছুন্নাহ (ছুন্নাতের ব্যাখ্যা)” (৪৭নং পর্ব)

এটি মুহ্তারাম আশ্শাইখ সালিহ্ আলফাওযান (c) কর্তৃক আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রখ্যাত ইমাম- ইমাম আল বারবাহারী (o) এর অনবদ্য গ্রন্থ “শারহুছ্ ছুন্নাহ”এর অতি চমৎকার ও মূল্যবান ব্যাখ্যাগ্রন্থের অডিও ভাষান্তর। বাংলা ভাষায় গ্রন্থটি ধারাবাহিকভাবে অডিও ভাষান্তর করছেন উছতায আবূ ছা`আদা হাম্মাদ বিল্লাহ c)। অদ্যকার আলোচনায় উছতায- হাশরের মাঠের শাফায়াত বা, সুপারিশ সংক্রান্ত বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। এছাড়াও তাতে নিম্নোক্ত বিষয়াদী সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে:-
১) ইমাম বারবাহারী o বলেন- আহলুছ্‌ ছুন্নাহ ওয়াল জামা‘য়াতের একটি উসূল বা মৌলিক বিশ্বাস হচ্ছে- ক্বিয়ামাতের দিন ভুল-ভ্রান্তি ও বিচ্যুতিকারীদের জন্য রাছূলুল্লাহ 1 সুপারিশ করবেন। পুলসিরাতেও তিনি গুনাহগারদের জন্য সুপারিশ করবেন। এর মাধ্যমে তিনি তাদেরকে জাহান্নামের গর্ত থেকে বের করে নিয়ে আসবেন।
২) কারা কারা সুপারিশের অধিকারী হবেন?
প্রত্যেক নাবীই সুপারিশের অধিকারী হবেন। তেমনিভাবে সিদ্দীক্বোন, শুহাদা এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণও সুপারিশের অধিকারী হবেন।
৩) শাইখ ফাওযান c বলেন- আহলুছ্‌ ছুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতে, সুপারিশ করার বিষয়ে কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-

ক) সুপারিশ অবশ্যই আল্লাহ্‌র (0) অনুমতি নিয়েই করতে হবে।
খ) যার ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে, তাকে অবশ্যই মূমিন হতে হবে।
গ) যাদের গুনাহ কুফ্‌রীর পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তাদের জন্য সুপারিশ করা হবে।
ঘ) কোনো কাফিরের ব্যাপারে সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
এই ব্যাপারে সূরা মুদ্দাছিরের ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-

فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

অর্থাৎ- তখন সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। ছূরা গাফিরের ১৮ নং আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-

مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ

অর্থাৎ- যালিমদের জন্য কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না, এমন কোন সুপারিশকারীও থাকবে না যার কথা গ্রহণ করা হবে।

৪) প্রধান সুপারিশকারী হবেন আমাদের নাবী মুহাম্মাদ 1। তিনি বিশেষ কিছু শাফায়াতের অধিকারী হবেন। যে অধিকার আর অন্য কাউকে দেওয়া হবে না। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি হাশ্‌রের ময়দানে সকলের জন্য সুপারিশ করবেন। তার সুপারিশের মাধ্যমেই হাশ্‌রের ময়দানে বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। হাশ্‌রের ময়দানে প্রচণ্ড গরম বিদ্যমান থাকবে। মানুষ দুর্দশাগ্রস্থ ও পিপাসার্ত থাকবে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য মানুষগণ “উলুল ‘আয্‌ম” রাছূলগণের নিকট যাবে। তারা পর্যায়ক্রমে আদাম 5-> নূহ 5-> ইব্রাহীম 5-> মূছা 5-> ‘ঈছা 5 এর কাছে যাবে। তারা প্রত্যেকেই এই ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য অপারগতা প্রকাশ করবেন। পরিশেষে তারা মুহাম্মাদ 1 এর কাছে যাবে। অতঃপর তিনি ছাজদাহরত অবস্থায় আল্লাহর (7) কাছে প্রার্থনায় মগ্ন হবেন। তখন আল্লাহ 0 বলবেন- আপনি প্রার্থনা করুন ও সুপারিশ করুন। সব ক্ববূল করা হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ 0 সূরা ইছরার ৭৯নং আয়াতে বলেন-

وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا

অর্থাৎ- আর রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়ুন, এটা আপনার জন্য নাফ্‌ল, শীঘ্রই আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রশংসিত স্থানে উন্নীত করবেন।

(এখানে মাক্বামে মাহ্‌মূদ বলতে এই শাফা‘য়াতে ‘উজমাকেই বুঝানো হয়েছে।)
৫) রাছূলুল্লাহ 1 এর সাধারণ সুপারিশ ২ রকম হতে পারে-

প্রথমতঃ যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেছে, তাদেরকে সুপারিশ করে জান্নাতে নিয়ে আসবেন।
দ্বিতীয়তঃ যারা ইতোমধ্যে জাহান্নামে চলে গিয়েছে, তাদেরকেও সুপারিশ করে জান্নাতে নিয়ে আসবেন। এই পর্যায়ের আহলুল কাবা-ইরদের জন্য রাছূল ছাড়াও অন্যান্য নাবীগণ, ওয়ালীগণ এবং আফরাত্বগণও সুপারিশ করতে পারবেন। (আফরাত্বঃ যারা ছোটকালেই ইন্তেকাল করেছে। তারা তাদের পিতা-মাতার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করবে।)

৬) জাহমিয়্যা, মু‘তাযীলা ও খাওয়ারীজরা শাফা‘য়াতের ব্যাপারে ভিন্ন আক্বীদাহ পোষণ করে।
খাওয়ারীজদের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরুপঃ-

ক) এরা মুছলিম শাসনকর্তার আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে।
খ) কাবীরাহ গুনাহকারীদেরকে এরা কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা আল্লাহ 0 প্রদত্ত দ্বীন থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই তাদের নাম খাওয়ারিজ (অর্থ- বেরিয়ে যাওয়া দল)।

৭) জাহমিয়্যা, মু‘তাযিলা ও খাওয়ারিজদের ভ্রান্ত আক্বীদাহ হলো- যারা একবার জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারবে না। তাদের জন্য কোনো সুপারিশও গ্রহণযোগ্য হবে না। এই কথার দালীল হিসেবে তারা ছূরা বাক্বারার ১৬৭ নং আয়াতকে উল্লেখ করে। যেখানে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেনঃ-

وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ

অর্থাৎ- এবং জাহান্নাম থেকে তারা বের হতে পারবে না।
(তাদের এই দালীলের বিষয়ে শাইখ সালিহ্‌ আল ফাউযান c বলেন- এই আয়াতে কাফিরদের কথা বলা হয়েছে।)

নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে শাফা‘য়াত সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
ছূরা বাক্বারার ২৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-

مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

অর্থাৎ- কে সেই ব্যক্তি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করে?

আবার, ছূরা আন্‌ নাজমের ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

অর্থাৎ- আকাশে কতই না ফিরিশতা আছে তাদের সুপারিশ কোনই কাজে আসবে না, তবে (কাজে আসবে) আল্লাহ b অনুমতি দেয়ার পরে, যার জন্য তিনি ইচ্ছে করবেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হবেন।
(এখানে মূমিনদের জন্য সুপারিশকে খাস করা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ 0মূমিন ছাড়া আর কারো প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন না।)
৮) আহলুছ্‌ ছুন্নাতের বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীরা আবার ২ ভাগে বিভক্ত। যেমন-

ক) জাহমিয়্যা, মু‘তাযিলা ও খাওয়ারিজরা শাফা‘য়াতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে।
খ) ক্বাবার পূজারী ও মাজার পূজারীরা শাফা‘য়াতের বিষয়ে অতিরঞ্জন করে।

৯) মানুষজন যখন সিরাত্ব অতিক্রম করতে থাকবে, তখনো রাছূলুল্লাহ 1 তাদের জন্য সুপারিশ করতে থাকবেন। কারণ, এই সিরাত্ব পার হওয়ার সময়ও অনেকেই জাহান্নামে পতিত হবেন। এই ব্যাপারে ছূরা মারই,য়ামের ৭১ নং আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-

وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا

অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাকে জাহান্নাম অতিক্রম করতে হবে না, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য ফায়সালা।
মানুষের সিরাত্ব পার হবার গতি তার কর্মের উপর ভিত্তি করে হবে।
এক্ষেত্রে, কেউ সিরাত্ব পার হবে চোখের পলকে, কেউ সিরাত্ব পার হবে বিজলীর গতিতে, কেউ সিরাত্ব পার হবে বাতাসের গতিতে, কেউ সিরাত্ব পার হবে দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ সিরাত্ব পার হবে উটের গতিতে, কেউ সিরাত্ব পার হবে হাটার ন্যায় গতিতে আবার কেউবা দলবদ্ধ মানুষের হাটার গতিতে এটি পার হবে। যার তাওহীদ যত শক্ত হবে, তার সিরাত্ব পারের গতিও তত দ্রুত হবে।
১০) সবার শাফা‘য়াত শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, মহান আল্লাহ 0 নিজ অনুগ্রহে অনেককে জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আসবেন। তারা জ্বলে কয়লা হয়ে যাওয়ার পরে তাদের বের করা হবে। অতঃপর, তাদেরকে হায়াতের নদীতে ছাড়া হবে। এর ফলে আবার নতুন করে তাদের দেহাবয়ব বিকশিত হবে গজাবে। এরপর তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
১১) চার ধরনের ব্যক্তি শাফা‘য়াত থেকে বঞ্চিত হবে। তারা হলো-

ক) সালাত পরিত্যাগকারী।
খ) যারা মিছকীনদের খাবার খাওয়ায় না।
গ) যারা ইছলামের সমালোচনাকারীদের সাথে থেকে ইছলামের সমালোচনা করে।
ঘ) যারা ক্বিয়ামাতের দিনকে অস্বীকার করে।

এই ব্যাপারে ছূরা মুদ্‌দাছ্‌ছিরের ৪৩-৪৮নং আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-

قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ وَلَمْ نَكُ نطْعِمُ الْمِسْكِينَ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ حَتَّى أَتَانَا الْيَقِينُ فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

অর্থাৎ- তারা বলবে- “আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, মিছকীনদেরকেও খাবার খাওয়াতাম না, আর সমালোচনাকারীদের সাথে সাথে আমরাও (সত্য পথের পথিকদের) সমালোচনা করতাম। আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম, আমাদের নিকট নিশ্চিত বিশ্বাস (অর্থাৎ মৃত্যু) না আসা পর্যন্ত”। তখন সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না।

১২) হাশ্‌রের দিনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের কী করতে হবে?
প্রথমতঃ কথায় এবং কাজে পরিপূর্ণরূপে আমাদেরকে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ রাছূলুল্লাহ 1 এর ছুন্নাহ অনুযায়ী আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ সম্পাদন করতে হবে।

 

ক্লাস শেষে নিম্নোক্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হয়:-
১) বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের ফিতনার মধ্য থেকে কোন একটি বিষয়ে যখন ত্বালিবুল ‘ইল্‌মদের মধ্যে কিংবা মাশাইখদের মধ্যে মতের ভিন্নতা দেখা দেয়, তখন অনেকেই আমাদের ভাই-বোনদের, ছালাফিইয়্যীনকে পরীক্ষা করে এই বলে যে, “আপনার সম্পৰ্ক কোন দলের সাথে”, “কোন দলকে সাপোর্ট করছেন”। প্রশ্নগুলো কোনো ত্বালিবুল ‘ইল্‌ম বা কোনো শাইখের পক্ষ থেকে আসছে না, বরং যারা দ্বীনী জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে একদম প্রারম্ভিক বা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে আসছে।
আপনি আমাদেরকে একটি সাধারণ দিক-নির্দেশনা দিন যে, কিভাবে আমাদের ভাই-বোনেরা এই ধরনের পরিস্থিতি মুক্বাবিলা করবেন পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে।

Subscribe to our mailing list

* indicates required
Close