ড. আশ্‌ শাইখ সালিহ্‌ আল ফাওযান কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত ইমাম আল বারবাহারী রচিত “শারহুছ্ ছুন্নাহ (ছুন্নাতের ব্যাখ্যা)” (৪৬নং পর্ব)

এটি মুহ্‌তারাম আশ্‌শাইখ সালিহ্ আল ফাওযান (c) কর্তৃক আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রখ্যাত ইমাম- ইমাম আল বারবাহারী (o) এর অনবদ্য গ্রন্থ “শারহুছ্ ছুন্নাহ”এর অতি চমৎকার ও মূল্যবান ব্যাখ্যাগ্রন্থের অডিও ভাষান্তর। বাংলা ভাষায় গ্রন্থটি ধারাবাহিকভাবে অডিও ভাষান্তর করছেন উছতায আবূ ছা`আদা হাম্মাদ বিল্লাহ (c)। অদ্যকার আলোচনায় উছতায- হাউযে কাউছারের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। এছাড়াও তাতে নিম্নোক্ত বিষয়াদী সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে:-
১) ইমাম বারবাহারী o বলেছেন, দ্বীনের অন্যতম বিষয় হল, হাউযে কাউছারের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। এবং প্রত্যেক নাবীরই আলাদা হাউয থাকবে। সালিহ 5 এর ক্ষেত্রে তার উটনীর ওলানই হবে তার হাউয।
এর ব্যাখ্যায় শাইখ ফাউযান c বলেন, ক্বিয়ামাতের দিন মানুষের প্রচণ্ড পিপাসা পাবে। তারা তাদের নিজ নিজ নাবীর হাউযে অবতরণ করবে। হাউযের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরুপ:-

ক) রাছূলুল্লাহ 1 এর হাউয হবে সবচেয়ে বড়। হাউযের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে এক মাসের চলার পথ। এটি বর্গাকার হবে।
খ) এর পানি দুধের চেয়েও সাদা এবং মুধুর চেয়েও মিষ্টি হবে। এর ঘ্রাণ হবে মিশকের ন্যায়।
গ) এর পেয়ালাগুলো আকাশের তারকারাজির ন্যায় হবে। অর্থাৎ, তারকারাজির মত উজ্জ্বল ও অসংখ্য।
ঘ) এটি (ক্বিয়ামাতের পরে) পরিবর্তিত পৃথিবীতে অবস্থিত হবে।
ঙ) যে ব্যক্তি একবার এই হাউয থেকে পানি পান করবে, সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।
তবে, মুরতাদ ও বিদ‘আতিরা এই পানি পানের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবে।

২) “সালিহ্‌ 5 এর ক্ষেত্রে তার উটনীর ওলানই হবে তার হাউয” ইমাম বারবাহারী o এর এ কথাটি সঠিক নয়।
কেননা, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন যে, প্রত্যেক নাবীর জন্য হাউয থাকবে। তারা প্রত্যেকেই কার হাউযে লোক কত বেশি হয় তা নিয়ে গর্ব করবেন। রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন যে, আমার হাউযেই সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হবে। যা নিয়ে আমি গর্ব করবজামি‘উত্‌ তিরমি্যী
এর স্বপক্ষে আরো হাদীছ রয়েছে।
৩) হাউয এবং কাউছার দুইটি কি একই জিনিস নাকি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস?
প্রকৃতপক্ষে পানি জমা থাকার গর্তকেই হাউয বলা হয়। এবং কাউছার বলতে বুঝায়- যার মধ্যে অনেক কল্যাণ রয়েছে।
শারী‘য়াতের পরিভাষায়- হাশ্‌রের মাঠে যে গর্তে পানি জমা থাকবে তাকেই হাউয বলা হয়। এবং কাউছার হলো- জান্নাতের একটি নদী। কেননা এর মধ্যে অসংখ্য কল্যাণ রয়েছে।
যেমন ছূরা কাউছারে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:- إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ অর্থাৎ- আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি।
আনাছ  4 থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:- আমি জান্নাতে ঘুরে বেড়াছিল্লাম, হঠাৎ দেখলাম একটি নদী প্রবাহিত হচ্ছে, যার দুই কিনারে মুতির তৈরি গম্বুজ, এর ভিতরটা ফাঁকা। অতঃপর আমি জিবরীল-কে (5) জিজ্ঞেস করলাম- এটা কি? উনি বললেন- এটি হচ্ছে- কাউছার, যেটি আপনার রাব আপনাকে দান করেছেন।সাহীহ্‌ বুখারী উক্ত হাদীছ থেকে জানা যায় যে, হাউয এবং কাউছার দুইটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস।
৪) এই হাউযকে ‘হাউযে কাউছার’ বলা হয় কেন?
অন্য নাবীদের হাউয থেকে রাছূলুল্লাহ 1 এর হাউয স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট সম্পন্ন, সেটি বুঝানোর জন্যই এমন নামকরণ। এই হাউযের পানির উৎপত্তিস্থল হলো কাউছার। এর দুইটি নালা রয়েছে। যার একটি স্বর্ণ ও আরেকটি রৌপ্য দ্বারা নির্মিত।
৫) যদিও হাউযে কাউছারের বিষয়টি ক্বোরআন, ছুন্নাহ ও ইজমা‘ দ্বারা প্রমাণিত। তাই একে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। যদিও ক্বোরআনে কারীমে হাউয সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে বলা হয়নি তবে পরোক্ষভাবে ছূরা কাউছারে এসম্পর্কে বলা হয়েছে।
উক্ত ছূরায় শুধুমাত্র “কাউছার” শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। হাউযের কথা উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু এই কাউছার থেকেই হাউযে পানি পৌঁছাবে, তাই এর নাম হাউযে কাউছার।
হাউযে কাউছারের বিষয়টি হচ্ছে অদৃশ্য। কিন্তু এটি ক্বোরআন, ছুন্নাহ ও ইজমা‘ দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম ত্বাহাওয়ী o তার ‘আক্বীদাতুত্‌ ত্বাহাওয়িয়্যাতে বলেছেন- হাউযে কাউছারের বিষয়টি সত্য। এটি হাশ্‌রের মাঠে অবস্থিত হবে।
হাদীছে এসেছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- এটি হচ্ছে হাউয। যেটি আল্লাহ আমাকে দান করেছেন।
মুতাওয়াতির পর্যায়ের বহু হাদীছ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। শাইখ আলবানী o বলেছেন- ৩০ জনেরও অধিক সাহাবী এই ব্যাপারে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
৬) হাউযের অবস্থানস্থল হাশ্‌রের মাঠে হবে, না-কি সীরাত ও মীযানের পরে হবে?
শাইখ সালিহ্‌ আল আশ্‌শাইখ c বলেন- হাউযের অবস্থান যদি সিরাত্বের পরে। তাঁর কথা হলো পুলসিরাত পার হওয়ার আগেই যদি হাউযের পানি পান করানো হয়, তাহলে তো জাহান্নামীরা তো আর পিপাসা না লাগার কারনে জাহান্নামের ‘আযাব পুরোপুরি ভোগ করবে না!
ইমাম বুখারীও (o) এই হাউযের বর্ণনাকে শাফা‘য়াতের অধ্যায়ের পরে নিয়ে এসেছেন। এ থেকে বুঝা যায় যে তার ভভিমত হলো- হাউয পুলসিরাতের পরে অবস্থিত।
আনাছ 4 থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি আমার জন্য ক্বিয়ামাতের দিন রাছূলুল্লাহ-কে (1) সুপারিশ করতে বললাম। রাছূলুল্লাহ 1 বললেন- আমি তা করব।
আমি বললাম- তখন আমি আপনাকে কোথায় খুঁজবো? তিনি বললেন- তুমি প্রথমেই আমাকে সিরাত্বে খুঁজবে। এখানে না পেলে মীযানে। এখানেও আমার দেখা না পেলে হাউযে খুঁজবে। এটা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সীরাত্ব ও মীযানের পরে হাউয অবস্থিত।
অন্য আরেকটি হাদীছ থেকে জানা যায়, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ করে একদল লোককে দেখলাম, তাদের মধ্যে থেকে একজন ফিরিশতা বের হয়ে আসলেন। তিনি আমাকে বললেন- তারা আগুনের দিকে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ফিরিশতা বললেন, আপনার মৃত্যুর পরে এরা কুফ্‌রিতে ফিরে গিয়েছিল।
আরেকটি হাদীছে এসেছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- আমার হাউযে কিছু লোক আসবে, তখন হঠাৎ করে তাদেরকে আমার থেকে আড়াল করে দেওয়া হবে। তখন রাছূলুল্লাহ 1 বলবেন- এরা তো আমার আসহাব (সাথী), তখন তাকে বলা হবে, হে নাবী! আপনি জানেন না যে, এরা আপনার মৃত্যুর পরে কি কি উদ্ভাবন করেছে (দ্বীনের মধ্যে)।
এসব হাদীছ থেকে জানা যায় যে, অনেক লোককে হাউযের পানি পান না করিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তাই এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, হাউযের অবস্থান হবে সীরাত্ব ও মীযানের পরে। কিন্তু যেহেতু এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, যদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সিরাত্ব পার হওয়ার পরে কাউকে জাহান্নামে পাঠানো হবে। তাই বলা যায় যে, হাউযের অবস্থান সিরাত্বের আগেই।
অনেকের মতে, এখানে দুইটি হাউয রয়েছে- একটি সিরাত্বের আগে, আরেকটি সিরাত্বের পরে।
৬) যারা পানি পানের সৌভাগ্য লাভ করবে, তারা সবাই কি নাজাত পেয়ে যাবে?
না, পানি পানই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে না। পানি পানের সৌভাগ্য অর্জনের পরও যদি কেউ জাহান্নামের উপযোগী হয়, তাহলে তাকে জাহান্নামেই যেতে হবে। তবে, সেখানে সে পিপাসার্ত হওয়ার ‘আযাব থেকে রেহাই পাবে।
৭) হাউযে কাউছারের আয়তন সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিছে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা লক্ষ করা যায়। যেমন-
এক হাদীছে এসেছে, হাউযে কাউছারের আয়তন হবে মাদীনা থেকে বায়তুল মাক্বদিছ পর্যন্ত (দূরত্বের সমান)।
অন্য হাদীছে এসেছে, হাউযে কাউছারের আয়তন হবে মাদীনা থেকে ওমান বা, ইয়ামানের সান‘আ পর্যন্ত (দূরত্বের সমান)।
এরকম আরো বর্ণনা রয়েছে, যেগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বের কথা বলা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো- বর্ণিত এসব হাদীছের মধ্যে আমরা কিভাবে সমন্বয় করব আর এসব ভিন্নতার কারণই বা কি?
উত্তর- প্রথমতঃ হয়তো সাহাবীদেরকে এর আয়তন বুঝানোর জন্য তাঁর বা তাদের নিজ নিজ এলাকার নাম ব্যবহার করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ 0 হয়তো রাছূলুল্লাহ-কে (1) ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বের কথা বলেছেন। হয়তো দিনে দিনে হাউযে কাউছারের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, হয়তো উম্মাত বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এর আয়তনও বৃদ্ধি পেয়েছে।
৯) হাউযে কাউছারের পানি পান করা থেকে অনেককেই বারণ করা হবে।
এই বারণ দুভাবে হতে পারে। একটি হল, ‘আমভাবে বারণ করা বা তাড়িয়ে দেয়া। পূর্ববর্তী নাবীর উম্মাতগণ এর অন্তর্গত। কারন, তাদের স্ব স্ব নাবীরাও যেন তাদের উম্মাতের আধিক্য নিয়ে গর্ব করতে পারেন। রাছূলুল্লাহ 1 তাদেরকে তাঁর হাউয থেকে তাড়িয়ে দেবেন, যেন তারা তাদের নাবীর হাউযে যায়।
অপরটি হল, বিশেষভাবে তাড়ানো। বিশেষভাবে যারা তাড়িত বা বারিত হবে তারা রাছূলুল্লাহ 1 এর উম্মাতেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। এদের সংখ্যা হবে কম। মুনাফিক্ব, মুবতাদী‘ ও মুছায়লামা কাজ্জাবের সময় মুরতাদ হয়ে যাওয়া লোকেরা এর অন্তর্ভুক্ত।
১০) কিছু বাতিলপন্থী দল হাউযে কাউছারের বিষয়কে অস্বীকার করে। যেমন- মু‘তাজিলীরা হাউযের বিষয়কে সরাসরি অস্বীকার করে। এবং রাফিযী ও খারিজীরা একে স্বীকার করে বটে, কিন্তু, তাদের মতে বেশিরভাগ কিবারুস্‌ সাহাবা (বড় বড় সাহাবাগণ) হাউযের পানি পান থেকে বঞ্চিত হবেন।
এদের অভিযোগগুলোকে শাইখ খণ্ডন করেছেন।
১১) পানি পান করার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য কি কি করণীয়?

ক) মূমীন ও মুছলিম হতে হবে।
খ) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাঁধা প্রদান করতে হবে।
গ) কাবীরাহ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
ঘ) সাব্‌র করতে হবে।


১. জামি‘উত্‌ তিরমি্যী 
২. সাহীহ্‌ বুখারী 

Subscribe to our mailing list

* indicates required
Close