নারীদের সম-সাময়িক বিভিন্ন সমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণের ক্বোরআন-ছুন্নাহ ভিত্তিক পথ ও পদ্ধতি (৩৯নং পর্ব)

উছতায আবূ ছা`আদাহ হাম্মাদ বিল্লাহ c ধারাবাহিক এই অডিও বক্তব্যে নারীদের সম-সাময়িক বিভিন্ন সমস্যা এবং এসকল সমস্যা থেকে উত্তোরণের পথ ও পদ্ধতি বিষয়ে ক্বোরআন-ছুন্নাহ্‌র আলোকে অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা পেশ করেছেন। পারিবারিক এবং বৈবাহিক জীবনে নারীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, সন্তানদের লালন-পালন করা, সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবার গড়ে তোলা, ঘরের বাইরে কাজ-কর্ম করা ইত্যাদি অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এই পর্বে উছতায হাম্মাদ বিল্লাহ c ‘কনে কিভাবে দেখতে হবে এবং কনের সাথে কথা বলা যাবে কি-না’ এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তন্মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিম্নে উল্লেখ করা হলো:-
১) রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- যখন কোনও পুরুষের মনে কোনো নারীকে বিয়ে করার ইচ্ছা হবে, তখন সে চাইলে তাকে দেখতে পারে।ইবনে মাজাহ অপর আরেকটি হাদিছে এসেছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন, কেউ যখন কোনে নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, তখন সম্ভব হলে সে যেন ওই নারীকে দেখে নেয়। ছূরা আহ্‌যাবের ৫২ নং আয়াতে এসেছে:

لَا یَحِلُّ لَكَ النِّسَآءُ مِنْۢ بَعْدُ وَ لَاۤ اَنْ تَبَدَّلَ بِهِنَّ مِنْ اَزْوَاجٍ وَّ لَوْ اَعْجَبَكَ حُسْنُهُنَّ

অর্থাৎ- অতঃপর আর কোন নারী তোমার জন্য বৈধ নয়। আর তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয়, যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে চমৎকৃত করে।
এই আয়াত দ্বারাও কনে দেখাটা প্রমাণিত হয়। কনে দেখা ওয়াজিব। কারণ, হাদীছে নির্দেশ সূচক শব্দ এসেছে। তবে, ইমাম আহ্‌মাদ o এর মতে এটি মুবাহ্‌। ওয়াজিব হলে না দেখে কেউ বিয়ে করতেন না। জামহূর ‘উলামায়ে কিরামের মতে- এটি মুছ্‌তাহাব।
২) কনে দেখতে যাওয়ার পূর্বে কিছু শর্ত রয়েছে। এ শর্তগুলো পালন করেই তবে কনে দেখতে হবে।
উছাইমীন o ৪টি শর্তের কথা বলেছেন। সেগুলো হলো-

ক) যদি দেখার প্রয়োজন হয়, তবেই দেখবে। নতুবা না দেখলেও হবে।
খ) একাকী দেখা যাবে না। অবশ্যই কনের মাহ্‌রাম সাথে থাকতে হবে। কারণ, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- দু’জন (গাইরে মাহ্‌রাম) নারী ও পুরুষ নির্জনে একাকী হলে তৃতীয়জন হয় শাইত্বান।
গ) দেখাটা অবশ্যই বিয়ের উদ্দেশ্যে হতে হবে। যেমন, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- যখন তোমাদের কেউ কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তখন সে চাইলে ওই নারীর দিকে দেখতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই।মুছনাদে আহ্‌মাদ
ঘ) তাকে মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়েই তবে কনে দেখতে যেতে হবে। এই শর্তটি মূলতঃ তৃতীয় শর্তেরই অন্তর্ভুক্ত। অনেকেই আরো একটি শর্তের কথা বলেছেন, তা হলো-
ঙ) সে যে মেয়েকে দেখতে যাবে, তার পরিবার থেকে সে অবশ্যই ভালো উত্তর পাবে- এমন সম্ভাবনা থাকতে হবে। অর্থাৎ, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে দেখতে যাওয়া যাবে না। উপরোক্ত ৫টি শর্তের মধ্যে যদি ১টিও বাদ যায়, তবে কনে দেখার ব্যাপারটি শারি‘য়াত সম্মত বলে গণ্য হবে না।

৩) কখন বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা হারাম বলে গণ্য হবে?

ক) প্রথমতঃ প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব দেওয়া যাবে না। এটি হারাম। যেমন- কনের এক জায়গায় বিয়ের কথা চলাকালীন সময়ে তাকে আর কোনো প্রস্তাব দেওয়া যাবে না। রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- কোনো লোক যেন তার ভাইয়ের প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব না দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আগের প্রস্তাবটি বাত্বিল বা প্রত্যাখ্যাত হয়।সাহীহ্‌ বুখারী তবে, এক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তাব যদি কোনো ফাছিক্ব ব্যক্তি পাঠায়, তবে তার প্রস্তাব বাত্বিল বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পূর্বেই একজন মুত্তাকী ব্যক্তি প্রস্তাব পাঠাতে পারে। কারণ, এর মধ্যে অনেক ফায়দা রয়েছে, একজন ফাছিক্বের উপর একজন মুমিনের প্রাধান্য রয়েছে। আর এর দ্বারা একজন মুছলিম নারীর দ্বীন ও ঈমান সংরক্ষিত হচ্ছে।
খ) দ্বিতীয়ত, ‘ইদ্দাত পালনকালীন সময়ে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া যাবে না। তবে, এই সময়ের মধ্যে তাকে ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া জা-ইয আছে। যেমন- ছূরা বাক্বারার ২৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ 7 ইরশাদ করেছেন:

وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُم بِهِۦ مِنْ خِطْبَةِ ٱلنِّسَآءِ أَوْ أَكْنَنتُمْ فِىٓ أَنفُسِكُمْ

অর্থাৎ- তোমাদের গুনাহ নেই, যদি তোমরা কথার ইশারায় নারীদেরকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাও, কিংবা নিজেদের মনে গোপন রাখো।

৪) কনে দেখতে যাওয়ার সময় বর কতটুকু সাজগোজ করতে পারবে?
এক্ষেত্রে বর উত্তম পোশাক পরিধান করে যেতে পারবে। তবে, তার পাকা চুলকে কলপ দিয়ে ঢাকতে পারবে না। অথবা, টাঁক ঢাকার জন্য পরচুলা ব্যবহার করতে পারবে না। মোটকথা, কোনও ধরনের প্রতারণা করতে পারবে না।
৫) কনের জন্য কতটুকু সাজগোজ করা জা-ইয?
এ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। যেমন, জাবির 3 থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- হে নারীর দল, তোমরা খিযাব গ্রহন কর, আল্লাহ্‌র (0) নিকট থেকে রিয্‌ক্ব লাভের জন্য। অর্থাৎ, সে স্বামীলাভের জন্য খিযাব লাগাতে পারে। সাহীহ্‌ মুছলিমের অপর আরেকটি হাদিছে ছুবাই‘আহ বিনতুল হারিছ আল আছলামিয়্যাহ رضي الله عنها এর একটি ঘটনা এসেছে, তার স্বামী সা’দ ইবনু খাওলাহ 3 ইন্তিক্বাল করলেন। তখন তিনি সন্তান সম্ভবা ছিলেন। পরবর্তীতে তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। অতঃপর তিনি বিয়ের জন্য সাজগোজ করতে থাকলেন। এমতাবস্থায়, বানু ‘আব্দিদ্‌ দার গোত্রের একজন সাহাবী আবু ছানাবীল 3 তার কাছে গিয়ে যখন তাকে এত সাজগোজ অবস্থায় দেখলেন, তখন তাকে বললেন-
“তোমাকে আমি সাজগোজ করা অবস্থায় কেন দেখছি? তবে কি তুমি বিয়ের আশা করছ? ৪ মাস ১০ দিন হওয়ার আগে তো তুমি বিয়ে করতে পারবে না। ছুবাই‘আহ বিনতুল হারিছ আল আছলামিয়্যাহ f বললেন- এই কথাটি আমার মনে আঘাত করল। তাই আমি রাছূলুল্লাহ 1 এর কাছে চললাম। আমি তাকে ব্যপারটি খুলে বললাম। রাছূলুল্লাহ 1 আমাকে বললেন যে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ই আমি হালাল হয়ে গেছি এবং আমি চাইলেই এখন বিয়ে করতে পারি।”
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মেয়ে তার হবু বরের জন্য সাজগোজ করতে পারে। এটি জা-ইয আছে। কিন্তু, ছূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে আছে যে:

وَقُل لِّلْمُؤْمِنَٰتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَٰرِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ ءَابَآئِهِنَّ أَوْ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَآئِهِنَّ أَوْ أَبْنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوْ نِسَآئِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ غَيْرِ أُو۟لِى ٱلْإِرْبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفْلِ ٱلَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا۟ عَلَىٰ عَوْرَٰتِ ٱلنِّسَآءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ

অর্থাৎ- আর ঈমানদার নারীদেরকে বলে দাও তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, আর তাদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করতে যা এমনিতেই প্রকাশিত হয় তা ব্যতীত। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাই-এর ছেলে, বোনের ছেলে, মহিলাগণ, স্বীয় মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা-রহিত পুরুষরা আর নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া অন্যের কাছে নিজেদের শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজেদের গোপন শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে।

এখন, ওই নারী যে বরের সামনে সাজগোজ করে বের হবেন, সেই বর তো উপরোক্ত আয়াতের আলোকে সেই সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত নন যাদের সামনে একজন নারী স্বীয় শোভা সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারে। তাই অনেক ‘আলিমদের মধ্যে এই ব্যপারে দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোন সংঘর্ষ নেই। কারণ, ক্বোরআনে উল্লেখিত আয়াতটি সাধারণক্ষেত্রে বলা হয়েছে। কিন্তু, বিয়ের উদ্দেশ্যে হবু বরের জন্য সাজগোজ করতে পারার বিষয়টি হাদীছ দ্বারা খাস করা হয়েছে। ঠিক যেমনিভাবে একজন পুরুষ কনে দেখার উদ্দেশ্যে সেই মেয়ের দিকে তাকানোর ব্যাপারটি হাদীছ দ্বারা খাস করা হয়েছে। তবে সাজগোজ অবশ্যই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই করতে হবে। যেমন, জামহূর ‘উলামাদের মতে, কনে সুরমা, কাজল, মেহেদী ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে কনে এমন কোনো মেকাপ নিতে (সাজসজ্জা করতে) পারবে না, যেটা তার দোষগুলো ঢেকে রাখে।
৬) একজন বর কনের কতটুকু দেখতে পারবে?
জামহূর ‘উলামাদের মতে, মুখমণ্ডল ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত দেখতে পারবে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, একজন নারী শুধুমাত্র তার হাত ও মুখমণ্ডল ই সাজাতে পারবে।
একজন বর শুধুমাত্র এই দুই অঙ্গই কেন দেখতে পারবে? এর কারণ কি?
কারণ, একজন মানুষের সৌন্দর্যের প্রমাণটা তার চেহারা দ্বারাই পাওয়া যায়। এবং হাত দেখলেই বুঝা যায় যে, তার শরীরে সতেজতা বা লাবণ্যটা আছে কি-না। আবার অনেকের মতে, কনে তার ওজুর অঙ্গগুলো বরের সামনে প্রকাশ করতে পারবে।
৭) বর যদি কনেকে লুকিয়ে দেখতে চায়, তবে কতটুকু দেখতে পারবে?
আহ্‌লুয্‌ যাহীরের মতে, প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা ব্যতীত পুরো শরীর দেখা যাবে। দাঊদ যাহিরীর মতে, একদম উলঙ্গ অবস্থায় দেখা যাবে। তাদের দালীল হল, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- একজন নারীর যে অঙ্গ দেখলে তাকে বিয়ে করার প্রতি তোমাদের আগ্রহ তৈরি হবে, তোমরা সেগুলো দেখো। আওযা‘য়ী o এর মতে, শরীরের গোশত বহুল অঙ্গগুলো দেখা যাবে। জামহূরের মতে, যে অঙ্গ দেখলে বিয়ে করার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে, সে চাইলে ওই অংশটুকু দেখতে পারে।

 

ক্লাস শেষে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদান করা হয়:-
১) যদি একজন ব্যক্তি জানে যে, একজন ফাছিক্ব লোক কোনো বোনকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে, এখন সে তাকে প্রস্তাব দিবে এই চিন্তা করে যে, এর দ্বারা বোনটি হয়তো আরো উত্তম উপকার লাভ করতে পারবে, বা হয়তো তাকে ফিতনা থেকে বাঁচানো যাবে, কিংবা এরকম কোনো কারণ ছাড়াই সে যদি তাকে বিয়ে করার জন্যই এটা করে, তাহলে এরুপ করা কি তার জন্য জা-ইয হবে?
২) যদি কোনো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসে, এমতাবস্থায় কোন শারিরীক সমস্যা যদি থেকে থাকে যা কিছুদিন পর পর ফিরে আসে, তাহলে সেই সমস্যার কথা কি বলে দেয়া উচিত না-কি বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত?
৩) কোনো বিয়েতে ছুন্নাহ্‌র নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করা না হলে পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক জীবনে “খাইর” ও “রাহ্‌মাহ” বৃদ্ধির জন্য কি বা কিভাবে ক্ষতিপূরণ আর অনুতাপ করা যেতে পারে?


১. ইবনে মাজাহ 
২. মুছনাদে আহ্‌মাদ 
৩. সাহীহ্‌ বুখারী 

Subscribe to our mailing list

* indicates required
Close