১) গত পর্বে আবূ ‘উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ 3 ও মু’আয ইবনু জাবাল 3 এর সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছটি কয়েকজন রাওয়ী থেকে মুছনাদে আহ্মাদে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীছটিকে অনেকে য‘য়ীফ বললেও এর একাধিক ছনদ বিদ্যমান থাকায় এই হাদীছটিকে হাছান লি-গায়রিহী বলা যায়। তাই এই বর্ণনাটিকে গ্রহণযোগ্য বলা যায়। এই হাদীছ থেকে জানা যায় যে, এই ত্বা‘ঊনের মধ্যেও তারা জামা‘আতে সালাত আদায় করেছেন এবং জুমু‘আর খুতবা দিয়েছেন।
২) ফার্য সালাত জামা‘আতে আদায় করার হুকুম কি?
‘আবুল্লাহ ইবনু ‘উমার 3 থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- ঘরে একাকি সালাত আদায় করার চেয়ে মাছজিদে সালাত আদায় করলে সাতাশ গুণ বেশি ছাওয়াব লাভ করা যায়।সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
ফার্য সালাত জামা‘আতে আদায়ের হুক্ম সম্পর্কে ‘উলামায়ে কিরামের ভিন্ন ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
ক) কারো মতে, ফার্য সালাত জামা‘আতে আদায় করা প্রত্যেক পুরুষের জন্য ওয়াজিবে ‘আইন। কারণ ক্বোরআনে কারীমে “اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ” নির্দেশ সূচক অর্থে এসেছে।
খ) জামহূর ‘উলামায়ে কিরামের মধ্য থেকে এক পক্ষের অভিমত হলো- ফার্য সালাত জামা‘আতে আদায় করা ছুন্নাত।
আর আরেক পক্ষের অভিমত হলো- ফার্য সালাত জামা‘আতে আদায় করা ওয়াজিবে কিফায়া। এই মতটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে ছালাফগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
জুমু’আর সালাতের হুক্ম-
এই ব্যাপারে সবাই একমত যে, জুমু’আর সালাত আদায় করা প্রত্যেক পুরুষের জন্য ওয়াজিব। তবে কারো মতে, জুমু’আর সালাত আদায় করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিবে ‘আইন। আর কারো মতে, জুমু’আর সালাত আদায় করা ওয়াজিবে কিফায়া।
ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ
অর্থাৎ- হে মূমিনগণ! জুমু‘আর দিনে যখন নামাযের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে সচেষ্ট হও।ছূরা আল-জুমু‘আ- ৯
এই আয়াত দ্বারা জুমু’আর সালাত ওয়াজিব বলে প্রমাণিত হয়। তাই এক্ষেত্রে শক্তিশালী অভিমত হচ্ছে- জুমু’আর সালাত আদায় করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিবে ‘আইন।
৩) বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ‘উলামাগণের নিকট থেকে মাছজিদে জামা‘আতে সালাত ও জুমু’আ না পড়ার নির্দেশনা এসেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা পেয়েই মুছলিম ও অমুছলিম রাষ্ট্রগুলো এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আর আমাদের ‘উলামাগণ অবশ্যই ক্বোরআন-ছুন্নাহ্র দলীলের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তারা যে দলীলের ভিত্তিতে এই নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই নির্দেশনার পিছনে সুস্পষ্ট এবং সাহীহ অথবা হাছান কোনো দলীল আমরা় পাইনি। ‘উলামায়ে কিরাম মূলতঃ ‘ইবারাতুন নাস-এর ভিত্তিতে নয় বরং ইশারাতুন নাস বা দালালাতুন্ নাস-এর ভিত্তিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
তাদের দলীলগুলো নিম্নরুপ-
ক) ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন- لَا تُلۡقُوۡا بِاَیۡدِیۡکُمۡ اِلَی التَّہۡلُکَۃِ
অর্থ- নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।ছূরা আল-বাক্বারা- ১৯৫
খ) ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 আরো ইরশাদ করেছেন- وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِکُمۡ رَحِیۡمًا
অর্থাৎ- তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।ছূরা আন্নিছা- ২৯
গ) ক্বোরআনে কারীমে অন্যত্র আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন- یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَ لَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ
অর্থাৎ- আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না।ছূরা আল-বাক্বারা- ১৮৫
ঘ) আবূ হুরাইরাহ 3 থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যেন সুস্থ ব্যক্তির নিকট না যায়।সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
ঙ) ‘আব্দুর রাহ্মান ইবনু ‘আউফ 3 থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- যখন তোমরা; কোনো এলাকা ‘ত্বাঊন আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে জানতে পারবে, তখন তোমরা সেখানে যাবে না। আর আক্রান্ত এলাকায় থাকলে সেখান থেকে পলায়ন করবে না।সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
চ) রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- তোমরা কুষ্ঠ রোগী থেকে সেভাবে পলায়ন করো, যেভাবে তোমরা বাঘ দেখলে পলায়ন করো।সাহীহ্ বুখারী
ছ) রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- তোমরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং একে অপরের ক্ষতি করো না।বায়হাক্বী
৪) সৌদির হাইআতু কিবারিল ‘উলামা-র ফাতওয়াতে মূলত তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-
ক) করোনা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য জুমু’আ এবং জামা’আতে সালাত আদায় করা হারাম।
এর প্রমাণ হলো রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন- সুস্থ ব্যক্তি যেনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তির নিকট না যায়।সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
রাছূলুল্লাহ 1 আরো বলেছেন- যখন তোমরা কোনো স্থান ত্বা‘ঊন আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে জানতে পারবে, তখন তোমরা সেখানে যাবে না। আর আক্রান্ত এলাকায় থাকলে সেখান থেকে পলায়ন করবে না।
খ) স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ যদি কোনো ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইন (বাধ্যতামূলক বিচ্ছিন্ন) করে রাখে, তবে অবশ্যই তাঁর উপর ওয়াজিব হচ্ছে যে, সে এই নির্দেশনা মেনে চলবে। কোয়ারেন্টাইনের জায়গাতেই সে তার সকল সালাত আদায় করবে।
এর প্রমাণ হলো- রাছূলুল্লাহ্র (1) নিকট ছাক্বীফ গোত্র থেকে একদল লোক বায়‘আত গ্রহণের জন্য আগমন করলেন। তাদের মধ্যে একজন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাই রাছূলুল্লাহ 1 আগে থেকেই তাঁর নিকট একজনকে পাঠিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, আমরা আপনার বায়’আত নিয়ে নিয়েছি। আপনি এখন চলে যান।সাহীহ্ মুছলিম
গ) কোনো ব্যক্তি যদি এই আশঙ্কা পোষণ করে যে, সে হয়তো ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবে বা তার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাহলে তাঁর জন্য জুমু’আ ও জামা‘আতে সালাত আদায় না করার অনুমতি রয়েছে।
৫) বাংলাদেশে বর্তমানে যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে, তা মূলত WHO কর্তৃক নির্দেশিত বিষয়। তবে ইছলামিক ফাউন্ডেশনও কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছে এবং ধর্মীয়ভাবেও বিষয়টা তারা ব্যাখ্যা করেছে। আমাদের ছালাফী মানহাজ হলো- যদি এমন কোনো নির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে আসে যা সরাসরি ইছলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক নয়, তবে তা মান্য করা আমাদের উপর ওয়াজিব।
কিন্তু যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদেরকে বলা হয় যে, আপনারা ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে চলেন, তাহলে বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।
সৌদির হাইয়াতু কিবারিল ‘উলামা কিন্তু এটা বলেনি যে, সকলের জন্যই মাছজিদে সালাত আদায় করা হারাম। বরং সেখানে বলা হয়েছে- করোনা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য জুমু’আ এবং জামা’আতে সালাত আদায় করা হারাম।