হাজ্ব ও ‘উমরাহর রুক্‌ন সমূহ

‘ইবাদতের ক্ষেত্রে রুক্‌ন বলা হয় সেই সব কাজ বা বিষয়কে, যেগুলো পালন ব্যতীত ‘ইবাদত বাতিল হয়ে যায় এবং ‘ইবাদত সঠিক বা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য যেগুলো সম্পাদনের কোন বিকল্প নেই।

হাজ্ব বা ‘উমরাহর রুক্‌ন হলো সেই সব কাজ বা বিষয়, যেগুলো পালন ব্যতীত হাজ্ব বা ‘উমরাহ আদায় হয় না বরং তা বাতিল হয়ে যায়।

‘উমরাহ্‌র ‍রুক্‌ন ৩টি।  ১। ইহরাম  ২। তাওয়াফ  ৩। ছা‘য়ী

হাজ্বের রুক্‌ন ৪টি।  ১। ইহরাম ২। তাওয়াফ  ৩। ছা‘য়ী ৪। ‘আরাফাহ্‌তে অবস্থান।

হাজ্বের প্রথম রুক্‌ন হলো ইহরাম।

ইহরাম কি, ইহরাম বলতে কি বুঝায়?

ইহরাম হলো হাজ্ব কিংবা ‘উমরাহ অথবা উভয়টি সম্পাদনের কাজে অনুপ্রবেশের দৃঢ় সংকল্প (নিয়্যাত) করা এবং তজ্জন্য ইহরামের কাপড় গায়ে জড়ানো, আর মুখে শুধুমাত্র হাজ্ব করতে চাইলে “আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা বি হাজ্বিন” আর ‘উমরা করতে চাইলে “আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা বি ‘উমরাতিন’’ অথবা হাজ্ব এবং ‘উমরাহ দু’টো আদায় করতে চাইলে “আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা বি  হাজ্বিন ওয়া ‘উমরাতিন” বলা।

অন্তরের দৃঢ় সংকল্প বা নিয়্যাত ছাড়া ইহরাম হবে না। রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ- إنما الأعمالبالنيات وإنما لكل إمرى مانوى.

অর্থঃ-কাজ হলো নিয়্যাত দিয়ে (অর্থাৎ-কাজের ফলাফল নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল)। প্রত্যেক লোক নিয়্যাত অনুযায়ী কর্মের ফলাফল লাভ করবে।সহীহ বুখারী ও সহীহ মুছলিম

আর যেহেতু নিয়্যাতের সম্পর্ক হলো অন্তরের সাথে, তাই কেউ যদি মনে প্রাণে হাজ্বে সম্পাদনের নিয়্যাত করে থাকে আর মূখে ‘উমরাহ’র তালবিয়াহ অর্থাৎ لبيك بعمرة (লাব্বাইকা বি ‘উমরাতিন) উচ্চারণ করে ফেলে, কিংবা কেউ যদি মনে প্রাণে ‍‘উমরাহ্‌ সম্পাদনের নিয়্যাত করে থাকে আর মূখে যদি সে হাজ্বের তালবিয়াহ অর্থাৎ لبيك بحج (লাব্বাইকা বি হাজ্জিন) বলে ফেলে, তাহলে এ ব্যাপারে আয়িম্যায়ে কেরামের সর্বসম্মত অভিমত হলো, সে ব্যক্তি অন্তরে যা নিয়্যাত করবে সেটি আদায় করাই তার উপর ওয়াজিব হবে, এক্ষেত্রে মুখের উচ্চারণটি ধর্তব্য নয়।

হাজ্বের দ্বিতীয় রুক্‌ন হলো ‘আরাফাহ্‌তে অবস্থান। ‘আরাফাহ্‌’র দিন অর্থাৎ ৯ই জিলহাজ্ব সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে যাওয়ার পর থেকে ১০ই জিলহাজ্ব ক্বোরবানির দিন ফজ্‌র প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পযর্ন্ত সময়ের মধ্যে অবশ্যই ‘আরাফাহ্‌তে অবস্থান করতে হবে। যদি কেউ এই সময়ের মধ্যে ‘আরাফাহ্‌তে অবস্থান না করে তাহলে তার হাজ্ব আদায় হবে না বরং তা বাতিল হয়ে যাবে।

কেননা  আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেনঃ-

فإذا أفضتم من عرفات فاذكروا الله عند المشعر الحرامالبقرة-٨٩١

অর্থাৎঃ-অতঃপর যখন তোমরা ‘আরাফাহ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে তখন পবিত্র স্মৃতি স্থানের  নিকট আল্লাহ্‌কে স্মরণ করো।ছূরা আল বাক্কারাহ–১৯৮

যেহেতু এই আয়াতে ‘আরাফাহ থেকে ইফাযাহ তথা প্রত্যাবর্তন বা ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে তাই তা প্রমাণ করে যে, ‘আরাফাহ্‌তে অবস্থান করতে হবে। কেননা কোথাও অবস্থান না করলে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন উঠে না।

এ ছাড়া মুছনাদে ইমাম আহমদ সহ অন্যান্য ছুনান গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে যে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ- الحج عرفة- الحج عرفة-  الحج عرفة অর্থাৎঃ- হাজ্ব হলো ‘আরাফাহ, হাজ্ব হলো ‘আরাফাহ, হাজ্ব হলো ‘আরাফাহ (অর্থাৎ-হাজ্ব হলো ‘আরাফাহ্‌তে অবস্থান) ।

ছূনানে আবূ দাউদের বর্ণনায় ‘আব্দুর রহমান বিন ইয়া‘মুর থেকে বর্ণিত, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-

الحج عرفة, من جاء قبل صلاة الصبح من ليلة جمع فقد تم حجه.

অর্থাৎঃ- হাজ্ব হলো ‘আরাফাহ্‌র দিন। যে ব্যক্তি ক্বোরবানির রাতে ফজ্‌রের নামাযের পূর্বে ‘আরাফাতে পৌছে গেল, তাহলে তার হাজ্জ্ব সম্পন্ন হয়ে গেল।

হাজ্বের তৃতীয় ‍রুকন হলো- তাওয়াফে ইফাযাহ। এটাকে তাওয়াফে যিয়ারাহও বলা হয়। ১০ই জিলহাজ্ব (ক্বোরবানির দিন) সকাল থেকে জিলহাজ্ব মাসের শেষ দিন পর্যন্ত যে কোন সময় এই তাওয়াফ করা যায়। এই তাওয়াফ শেষ হলে পরে একজন হাজ্বির জন্যে হাজ্জকালীন নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ চুড়ান্ত ভাবে সিদ্ধ তথা হালাল হয়ে য়ায়।

তাওয়াফে ইফাযাহ হলো হাজ্বের অন্যতম রুক্‌ন। এটি সম্পন্ন না করলে হাজ্ব আদায় হবে না। কেননা ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 7 ইরশাদ করেছেনঃ-

وليطوفوا بالبيت العتيقالحج- ٩٢

অর্থাৎ- এবং অবশ্যই তোমরা বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করো।ছূরা আল হাজ্ব-২৯

এছাড়া উম্মে ছালামাহ h থেকে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে যে, রাছূলুল্লাহ (1) ওয়াহ্‌ব বিন যাম‘আহ-কে (3) ক্বোরবানির দিন (জিলহাজ্বের ১০ তারিখ) বিকেলে সাধারণ পোষাক পরিহিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ- هل أفضت يا أبا عبد الله

অর্থাৎ-হে আবূ ‘আব্দুল্লাহ (ওয়াহ্‌ব বিন যাম‘আহ্‌’র কুনইয়া ছিল আবূ ‘আব্দুল্লাহ) তুমি কি তাওয়াফে ইফাযাহ করেছ? তিনি বলেলেনঃ-

لا والله يارسول الله! অর্থাৎঃ- না, আল্লাহর ক্বছম-আমি তা করিনি হে আল্লাহ্‌র রাছূল! তখন রাছূলুল্লাহ 1 তাঁকে বললেনঃ- إنزع عنك القميص

অর্থাৎঃ- তুমি (পরনের সাধারণ) জামা খুলে ফেলো (এবং ইহরামের কাপড় পরে নাও)।

ওয়াহ্‌ব বিন যাম‘আহ 3 সাথে সাথে মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন এবং তার সাথে যিনি ছিলেন তিনিও তার মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। অতঃপর ওয়াহ্‌ব বিন যাম‘আহ 3 রাছূলুল্লাহ-কে (1) জিজ্ঞেস করলেনঃ- لم يارسول الله অর্থাৎঃ- কেন  (এ আদেশ) হে আল্লাহ্‌র রাছূল?

রাছূলুল্লাহ 1 তাকে বললেনঃ-

إن هذا اليوم رخص لكم إذا أنتم رميتم الجمرة أن تحلوا يعنى من كل ما حرمتم منه إلاالنساء, فإذا امسيتم قبل أن تطوفوا هذا البيت صرتم حرما كهيئتكم قبل أن ترموا الجمرة قبلأن تطوفوا به. 
(رواه أبو اود والحاكم وابن خزيمة وصححه الألبانى)

অর্থাৎঃ- আজকের এই দিনে তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে যে তোমরা পাথর নিক্ষেপের পর শুধুমাত্র স্ত্রী ব্যতীত ইহরামের কারণে নিষিদ্ধ অন্য সব কিছু হালাল করে নিতে পার। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত (সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বে) যদি তোমরা বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফ (তাওয়াফে ইফাযাহ) সম্পন্ন না কর তাহলে পাথর নিক্ষেপের পূর্বে তোমরা যেভাবে মুহরিম ছিলে (তোমাদের জন্য যা কিছূ নিষিদ্ধ ছিল) পূণরায় তোমরা সে অবস্থায় ফিরে যাবে যতক্ষন না তোমরা তাওয়াফ সম্পন্ন করবে।আবূ দাঊদ, মুছতাদরাকে হাকিম, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ। শাইখ আল আলবানী o হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন।

হাজ্বের চতুর্থ ‍রুকন হলো-সাফা ও মারওয়ার মাঝে ছা‘য়ী।

হাজ্ব ও ‘উমরাহর চতুর্থ রুকন্ হলোঃ- সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের  মাঝে ছা‘য়ী করা অর্থাৎ দ্রুত সাত বার চক্বর দেয়া। এই সা‘য়ী সাফা পাহাড় থেকে শুরু করা আর মারওয়া পাহাড়ে যেয়ে  শেষ করা।

এর প্রমাণ হলো-ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেনঃ-

إن الصفا والمروة من شعائر الله فمن حج البيت أواعتمر فلا جناح  عليه أن يطوف بهماالبقرة- ٨٥١

অর্থাৎঃ- নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া হলো আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ্‌র হাজ্জ বা ‘উমরাহ করবে সে যদি এ দু’টোর তাওয়াফ করে তাহলে তার উপর কোন গুনাহ নেই।ছূরা আল বাক্বারাহ ১৫৮

এসম্পর্কে রাছূলুল্লাহ (1) বলেছেনঃ-

يأايها الناس اسعوا فإن السعى قد كتب عليكم.رواه البيهقى والدار قطنى

অর্থাৎঃ-হে লোকজন! তোমরা ছা‘য়ী করো, কেননা তা তোমাদের উপর ফর্‌য করে দেয়া হয়েছে। (বাইহাক্বী, দারু ক্বোতনী,)

অন্য বর্ণনায় রয়েছে-রাছূলুল্লাহ (1) বলেছেনঃ-

إسعوا فإن الله كتب عليكم السعى رواه أحمد و إبن ماجة১০

অর্থাৎঃ-তোমরা ছা‘য়ী করো, কেননা আল্লাহ তোমাদের উপর ছা‘য়ী আবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। (মুছনাদে ইমাম আহমদ, ইবনু মাজাহ)

এ ছাড়া আয়েশাহ h থেকে বর্ণিত যে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেনঃ-

ما أتم الله حج إمرى ولا عمرته ما لم يطف بين الصفاء والمروةرواه البخارى ومسلم১১

অর্থাৎঃ-আল্লাহ (0) সেই ব্যক্তির হাজ্ব পূর্ণ করেন না যতক্ষণ না সে সাফা ও মারওয়ার মাঝে তাওয়াফ সম্পাদন করে ।সহীহ বুখারী ও সহীহ মুছলিম১২

যে ব্যক্তি তামাত্তু‘ হাজ্ব পালন করবে তার জন্য সাফা ও মারওয়ার মধ্যকার ছা‘য়ী, তাওয়াফে ইফাযাহ তথা তাওয়াফে ক্বোদূম (বায়তুল্লায় আগমন কালীন তাওয়াফ) সম্পাদনের পরই কেবল করতে হবে, আগে (তাওয়াফে ইফাযাহ সম্পাদনের আগে) করলে চলবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ক্বেরান বা ইফরাদ হাজ্ব পালন করবে সে ব্যক্তি সাফা ও মারওয়ার মধ্যকার ছায়ী তাওয়াফে ইফাযাহ্‌র সম্পাদনের পরে যেমন করতে পারে তেমনি ইচ্ছে করলে সে তা এর আগেও (তাওয়াফে ইফাযাহ্‌ সম্পাদনের আগেও) করতে পারে। তবে  পরে করাটাই উত্তম।

সূত্রাবলীঃ-

১। আল ‘আল্লামা আশ্‌শাইখ ‘আব্দুল ‘আযীয বিন বায (o) সংকলিত “আত্‌তাহক্বীক্ব ওয়াল ঈযাহ—–”।

২। আল ‘আল্লামা আল মুহাদ্দিছ আশ্‌শাইখ নাসিরুদ্দীন আল আলবানী (o) সংকলিত মানছিকুল হাজ্ব ওয়াল ‘উমরাহ ফিল কিতাব ওয়াছ্ ছুন্নাহ ওয়া আ-ছারিছ ছালাফ”।

৩। আল ‘আল্লামা আশ্‌শাইখ ‘আব্দুল মুহছিন হামদ আল ‘আব্বাদ (c) সংকলিত “তাবসীরুন নাছিক বি আহকামিল মানাছিক”।

৪। আল ‘আল্লামা আশ্‌শাইখ মোহাম্মাদ বিন সালেহ আল ‘উছাইমীন (o) সংকলিত “আশ্‌শারহুল মুমতি”।

৫। আশ্‌শাইখ ‘আব্দুল্লাহ বিন ‘আব্দুর রহমান আল জিবরীন (c) ও আশ শাইখ ‘আব্দুল মুহছিন বিন নাসির আল ‘উবাইকান(c)  সংকলিত “আল মিনহাজ ফী  ইয়াওমিয়া-তিল হা-জ্ব”।

৬। আশ্‌শাইখ জামীল যাইনু (o) রচিত ও সংকলিত “ আরকানুল ইছলাম ওয়াল ঈমান”।

৭। আল ‘আল্লামা আশ্‌শাইখ মোহাম্মদ বিন সালেহ আল ‘উছাইমীন (o) রচিত ও সংকলিত “কাইফা ইয়ুআদ্দিল মুছলিমু মানাছিকাল হাজ্ব ওয়াল ‘উমরাহ ওয়া আখতা ইয়াক্বা‘উ ফীহাল হুজ্জাজ”।

৮। “বিদায়াতুল মুজতাহিদ ওয়া নিহায়াতুল মুক্বতাসিদ” লিল ইমাম মোহাম্মদ বিন আহমদ  আল ক্বোরতুবী (o)।

৯। “ফিক্বহুছ ছুন্নাহ” লিল ‘আল্লামা আছ ছায়্যিদ আছ ছাবিক্ব (o)।

১০। “আল ফিক্বহু ‘আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ” লিশ্‌শাইখ ‘আব্দুর রহমান আল জাযীরী (o)।


১. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুছলিম 
২. البقرة-٨٩١ 
৩. ছূরা আল বাক্কারাহ–১৯৮ 
৪. الحج- ٩٢ 
৫. ছূরা আল হাজ্ব-২৯ 
৬. আবূ দাঊদ, মুছতাদরাকে হাকিম, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ। শাইখ আল আলবানী o হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। 
৭. البقرة- ٨٥١ 
৮. ছূরা আল বাক্বারাহ ১৫৮ 
৯. رواه البيهقى والدار قطنى 
১০.  رواه أحمد و إبن ماجة 
১১. رواه البخارى ومسلم 
১২. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুছলিম 

Subscribe to our mailing list

* indicates required
Close