ক্বোরবানীর তাৎপর্য ও বিধান

আল্লাহ্‌র (0) নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রায় সকল উম্মাতের মধ্যেই ক্বোরবানীর প্রচলন ছিল। এটা আগেকার নাবীগণেরও ছুন্নাত ছিল। ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:-

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِسورة الحج- ٣٤

অর্থাৎ- আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য ক্বোরবানীর নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছি, যাতে জীবনোপকরণ স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে যেসব চতুষ্পদ জন্তু দান করেছেন সেগুলোর উপর আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করে।ছূরা আল হাজ্জ- ৩৪

উক্ত আয়াতে চতুষ্পদ জন্তুর উপর আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করার অর্থ হলো- আল্লাহ্‌র নামে যবেহ্‌ করা।

আমাদের দ্বীনে ইছলামে ক্বোরবানী, একনিষ্ঠ ও একত্ববাদীগণের ইমাম; মুছলিম জাতির পিতা ইবরাহীম 5 এর ছুন্নাত হিসেবে গৃহীত।

ইবরাহীম 5 এর প্রাণপ্রিয় পুত্র ‘আরব জাতির পিতা ইছমা‘য়ীল-কে (5) যবেহ্‌ করার পরিবর্তে তাঁর স্থলে আল্লাহ 7 এক মহান ভেড়া ক্বোরবানীর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর আল্লাহ্‌র (0) নির্দেশে ইবরাহীম 5 ইছমা‘য়ীল-কে (5) ক্বোরবানী দেয়ার পরিবর্তে সেই ভেড়া ক্বোরবানী দিয়েছিলেন। এ ছিলো আল্লাহ্‌র (0) এক অপরিসীম দয়া ও অনুকম্পা।

এ কারণেই ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম ও অন্যান্য ‘উলামায়ে কিরাম (p) বলেছেন যে, “হাদ্‌ইয়ু (হাজ্জ বা ‘উমরাহ পালনকারী আল্লাহ্‌র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য মাক্কাহ্‌তে যে পশু জবাই করে থাকেন, সেটাকে হাদইয়ু বলা হয়) বা ‘ঈদুল আয্‌হা উপলক্ষে যিলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ (অর্থাৎ ইয়াওমুন্‌ নাহ্‌র এর এক দিন এবং তাশ্‌রীক্বের তিন দিন) পর্যন্ত নির্দিষ্ট পশু যবেহ করা, মূলত: এটি হলো প্রাণের বিনিময়”।

আল্লাহ 0 যদি ইবরাহীম ও ইছমা‘য়ীল (n) এর প্রতি এই অনুগ্রহটুকু না করতেন,  তাহলে আজ হয়তো প্রতি বছর মুছলমানদের হাদইয়ু বা ‘ঈদুল আয্‌হা উপলক্ষে শত সহস্র মানুষ জবাই করতে হতো।

ক্বোরবানীর বিধান:- ফিক্বহ্‌ বিশেষজ্ঞ অনেক ‘উলামা ও আয়িম্যায়ে কিরামের মতে আর্থিক দিক থেকে সামর্থবান (যার নিকট মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে, যদিও তা নিসাব পরিমাণ না হয়) প্রাপ্তবয়স্ক মুছলমানের জন্য ক্বোরবানী প্রদান করা ছুন্নাতে মুআক্কাদাহ তথা অতীব জরুরী পালনীয় ছুন্নাত।

ইমাম আবূ হানীফাহ, ইমাম আহ্‌মাদ ইবনু হাম্বাল, এক বর্ণনামতে ইমাম মালিক, ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (p) প্রমুখ ‘উলামায়ে কিরামের মতে প্রাপ্তবয়স্ক, সামর্থবান (ইমাম আবূ হানীফাহ o– এর মতে এক্ষেত্রে সামর্থবান বলতে যার নিকট নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ রয়েছে তাকে বুঝায়), মুক্বীম (স্বীয় আবাসস্থলে অবস্থানকারী) মুছলমানের উপর ক্বোরবানী করা ওয়াজিব।

তবে যাই হোক, ক্বোরবানী করা শারী‘য়াতে ইছলামিয়াহ্‌র অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী পালনীয় বিধান, তাতে কারো কোন দ্বিমত নেই। কেউ যদি ক্বোরবানী করবে বলে মানত করে, তাহলে তার উপর ক্বোরবানী করা ওয়াজিব- এ বিষয়েও কারো কোন দ্বিমত নেই। এমনিভাবে কেউ যদি একটি পশু ক্রয় করার পর বলে যে, “এ পশুটি আমি ক্বোরবানী দেয়ার জন্য ক্রয় করেছি” কিংবা “এটি আমার ক্বোরবানীর পশু” তাহলে নির্ধারিত সেই পশুটি ক্বোরবানী করা তার উপর ওয়াজিব- এ বিষয়েও আয়িম্মায়ে কিরামের কারো কোন দ্বিমত নেই।

রাছূলুল্লাহ 1 আল্লাহ্‌র (0) নৈকট্য কামনায় মুক্বীম এবং মুছাফির সর্বাবস্থায় প্রত্যেক বছর (মাদানী জীবনের দশ বছর) ক্বোরবানী করেছেন।

ক্বোরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী:-

ক্বোরবানী সঠিক-শুদ্ধ হওয়ার জন্য ৬টি শর্ত রয়েছে। তন্মধ্যে যদি একটি শর্তও না পাওয়া যায়, তাহলে ক্বোরবানী সঠিক ও বিশুদ্ধ হবে না বা ক্বোরবানী আদা হবে না।

শর্ত ৬টি হলো, যথা:-

১) নিম্নলিখিত যে কোন প্রকার গবাদিপশু হতে হবে :- (ক) উট (খ) গরু (গ) ছাগল (ঘ) ভেড়া বা দুম্বা। এগুলোর নর বা মাদি।

২) ক্বোরবানীর পশুটি শারী‘য়াত নির্ধারিত বয়সী হতে হবে। আর তা হলো:- ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা- এক বছর পূর্ণকারী এবং ২য় বছরে পদার্পণকারী হতে হবে।

গরু- দুই বছর পূর্ণকারী এবং ৩য় বছরে পদার্পণকারী হতে হবে।

উট- পাঁচ বছর পূর্ণকারী এবং ষষ্ঠ বছরে পদার্পণকারী হতে হবে।

মোটকথা, উট হোক কিংবা গরু, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা- এগুলোর নর বা মাদি যা-ই হোক না কেন, অবশ্যই সেটাকে কমপক্ষে মূল (দুধ দাঁত নয়) দুই দাঁত বিশিষ্ট হতে হবে। আর সাধারণত উপরে উল্লেখিত বয়স হলেই এই দাঁত দু’টি গজায়।

তবে ক্বোরবানীর বয়স পূর্ণ হওয়ার পরেও যদি পশুটির দাঁত না গজায় এবং তার ক্বোরবানীর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে এক্ষেত্রে ঐরূপ পশু দিয়ে ক্বোরবানী আদা করা জায়িয, তাতে আল্লাহ 0 চাহেতো কোন অসুবিধা নেই।

৩) ক্বোরবানীর পশুটি নিম্নোক্ত ত্রুটিসমূহ হতে মুক্ত হতে হবে :-

(ক) স্পষ্ট কানা। আর তা দুই চোঁখ হোক বা এক চোঁখ, বাহ্যত: চোঁখ থাকুক বা না-ই থাকুক। মোটকথা, পশুটির অন্ধত্ব যদি স্পষ্ট হয়, তাহলে এমন পশু দিয়ে ক্বোরবানী জায়িয হবে না। কিন্তু যদি স্পষ্ট কানা না হয়, যেমন চোঁখের যৎসামান্য অংশ (চার বা তিনভাগের একভাগ) যদি সাদা হয়ে যায় কিংবা তার অন্ধত্ব প্রকাশ না পায়, পশুটি যদি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে, তাহলে এরূপ পশু ক্বোরবানী করা জায়িয।

(খ) স্পষ্ট রোগী। অর্থাৎ যে পশুটির মধ্যে রোগের ছাঁপ স্পষ্ট, দেখেই বুঝা যায় যে পশুটি রোগাক্রান্ত। যেমন- প্রচন্ড দুর্বল, নিস্তেজ, প্রচন্ড জ্বরে বা কাশিতে আক্রান্ত, যদ্দরুণ চলে-ফিরে খেতে পারছেনা কিংবা খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছে অথবা শরীরে এমন ঘা, পচন বা চর্মরোগ দেখা দিয়েছে যা তার গোশ্‌তকে আক্রান্ত করে ফেলেছে অথবা তার শরীর-স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে ফেলেছে। এরকম পশু দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয নয়। তবে যদি তার রোগ স্পষ্ট বা প্রকাশিত না হয়, যেমন- বাহ্যিকভাবে পশুটিকে দেখে রোগগ্রস্থ বলে মনে না হয় কিংবা সাধারণ এমন কোন রোগ হয় যেটি পশুর শরীর বা স্বাস্থ্যের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়, তাহলে এরকম পশু দ্বারা ক্বোরবানী করা জায়িয।

(গ) স্পষ্ট খোঁড়া বা লেংড়া। অর্থাৎ যে পশুটি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না। মাঠে-পথে তার স্বজাতি অন্যান্য সুস্থ পশুদের সঙ্গে একসাথে হাটা-চলা করতে অক্ষম- এমন পশু ক্বোরবানী করা জায়িয নয়। তবে হ্যাঁ, খোঁড়ামী যদি স্পষ্ট না হয়; তা যদি প্রকাশ না পায়, যেমন- পশুটি তার পায়ে কিছুটা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মোটামুটি স্বাভাবিকভাকে স্বজাতি অন্যান্য সুস্থ পশুদের সাথে হাটা-চলা করতে পারে, তাদের সাথে ঘুরে-ফিরে খেতে পারে, তাহলে এরূপ পশু ক্বোরবানী করা জায়িয।

(ঘ) প্রচন্ড জীর্ণশীর্ণ হাড্ডিসার। অর্থাৎ যে পশুটি অতিশয় জীর্ণশীর্ণ, শরীরে গোশ্‌ত নেই বললেই চলে। এরকম পশু দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয নয়।

উপরোক্ত চার প্রকারের যে কোন প্রকার ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয নয়। এর প্রমাণ হলো- বারা ইবনু ‘আযিব 3 হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা রাছূলুল্লাহ 1 খুতবাহ্‌ দিতে আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন, অতঃপর তিনি বললেন:-

أَرْبَعٌ لَا تَجُوزُ فِي الْأَضَاحِيِّ ; الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا ، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا ، وَالْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ ظَلْعُهَا وَالْعَجْفَاءُ الَّتِي لَا تُنْقِي.رواه الترمذي-١٤٩٧. وأبو داؤد- ٢٨٠٢ . وابن ماجة- ٣١٤٤

অর্থ- ক্বোরবানীর ক্ষেত্রে চার প্রকার পশু দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয নয়- স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগগ্রস্থ, স্পষ্ট খোঁড়া এবং অতিশয় জীর্ণশীর্ণ; হাড্ডিসার।তিরমিযী- ১৪৯৭। আবূ দাঊদ- ২৮০২। ইবনু মাজাহ্‌- ৩১৪৪

মুআত্তা ইমাম মালিক গ্রন্থেও বারা ইবনু ‘আযিব 3 থেকে অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত রয়েছে।

যেহেতু এসকল হাদীছে উল্লেখিত চার প্রকার ত্রুটিযুক্ত পশু ক্বোরবানী করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, সুতরাং এর চেয়ে মারাত্মক ও বেশি ত্রুটিযুক্ত পশু ক্বোরবানী করা যে নিষিদ্ধ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন- খোঁড়ার স্থলে যদি পশুটির এক হাত অথবা এক পা কাটা হয় বা ভাঙ্গা হয় কিংবা কোমর ভাঙ্গা হয় যে পিছন দিক উঠাতে পারে না, তাহলে এরূপ পশু দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয হবে না। এ ব্যাপারে আয়িম্মায়ে কিরামের কারো কোন দ্বিমত নেই। অনেক ‘উলামায়ে কিরামের মতে, উল্লেখিত চার প্রকার ত্রুটির সমান তথা সমপর্যায়ের অন্যান্য ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাও ক্বোরবানী জায়িয নয়। পক্ষান্তরে এই চার প্রকার ত্রুটির অন্তর্ভুক্ত নয় এমন ছোটখাঁটো ত্রুটি বা খুঁত যেটি পশুর শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় কিংবা তার মোটা-তাজা হওয়ার পথে অন্তরায় নয় কিংবা তার মূল্য হ্রাসের কারণ নয়, এরূপ কোন দোষ-ত্রুটিযুক্ত পশু ক্বোরবানী করা জায়িয। এ বিষয়ে আয়িম্মাহ্‌ ও ‘উলামায়ে কিরামের কারো কোন দ্বিমত নেই। যেমন- কানের সামান্য অংশ কাটা বা ছিদ্রযুক্ত পশু, কম লোম বিশিষ্ট পশু, শিংয়ের উপরের খোসা উঠে যাওয়া পশু, শিংয়ের অগ্রভাগের সামান্য বা এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ ভেঙ্গে যাওয়া পশু দ্বারা ক্বোরবানী আদা করা জায়িয তথা বৈধ রয়েছে। তবে প্রত্যেক ক্বোরবানী দাতাকে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, সুন্দর, সুঠাম, হৃষ্টপুষ্ট ও নিখুঁত পশু ক্বোরবানী করাই হলো সবচেয়ে উত্তম।

অনেক পশুর গায়ে ছোট ছোট গ্লান্ড দেখা যায়, এটা আসলে ধর্তব্য কোন রোগ বা ত্রুটি নয়, এরূপ পশু ক্বোরবানী করা জায়িয তথা বৈধ রয়েছে। তবে হ্যাঁ, গ্লান্ডের কারণে যদি পশুর শরীর-স্বাস্থ্যের কোনরূপ ক্ষতি হয়ে থাকে, কিংবা গ্লান্ডের কারণে পশুটির গোশ্‌ত যদি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে এরূপ পশু দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয নয়। আর যদি সাধারণ কোন টিউমার হয়ে থাকে, তাহলে এরূপ পশু দিয়ে ক্বোরবানী দেয়া যদিও জায়িয রয়েছে, তবে তা মাকরূহ্‌।

মল-মূত্র বন্ধ হয়ে যে পশুটির পেঠ ফুলে বা ফেঁপে গেছে এমন পশুর পেশাব-পায়খানা হয়ে শঙ্কামুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তদ্বারা ক্বোরবানী করা জায়িয নয়।

উপর থেকে পড়ে গিয়ে কিংবা অন্য কোন কারণে যে পশুটির মরণাপন্ন অবস্থা, এমন পশু দিয়ে ক্বোরবানী জায়িয নয় যতক্ষণ না সেটি শঙ্কামুক্ত হবে।

৪) ক্বোরবানী সঠিক-শুদ্ধ হওয়ার জন্য চতুর্থ শর্ত হলো- ক্বোরবানী দাতাকে অবশ্যই ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত পশুটির বৈধ মালিক হতে হবে অথবা বৈধ মালিকের কিংবা শারী‘য়াতের পক্ষ হতে যথাযথ অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে। সুতরাং চুরি করা, ছিনতাই করা, অন্যায় বা মিথ্যা দাবির মাধ্যমে গৃহীত পশুর দ্বারা ক্বোরবানী জায়িয হবে না। কেননা আল্লাহ্‌র (0) নাফরমানীর মাধ্যমে তো তাঁর নৈকট্য বা সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না।

কোন ইয়াতীম যদি পর্যাপ্ত সম্পদের মালিক হয়ে থাকে এবং ক্বোরবানী না দিলে যদি তার মন ভেঙে পড়ে অর্থাৎ দুঃখবোধ করে, তাহলে এমতাবস্থায় ইয়াতীমের অভিভাবক তার অনুমতি স্বাপেক্ষ ক্বোরবানী দিতে পারবেন।

৫) ক্বোরবানীর পশুটির মধ্যে অন্য লোকের অধিকার যেন সম্পৃক্ত বা সংযুক্ত না থাকে। অর্থাৎ পশুটি যেন কারো কাছে দায়বদ্ধ কিংবা কারো কাছ থেকে বন্ধক নেয়া অথবা কারো নিকট বন্ধক দেয়া না হয়।

উপরোক্ত ৫টি শর্ত কেবল ক্বোরবানীর পশুর ক্ষেত্রেই নয়; হাজ্জে তামাত্তু‘ বা হাজ্জে ক্বিরানের হাদইয়ু এবং ‘আক্বীক্বার পশুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

৬) ক্বোরবানীর পশু অবশ্যই শারী‘য়াত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ক্বোরবানী করতে হবে। অর্থাৎ ১০ই যিলহাজ্জ ‘ঈদের সালাতের পর থেকে (যে শহরে বা এলাকায় একাধিক ‘ঈদের সালাতের জামা‘আত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, সেখানে প্রথম জামা‘আত সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকে) আয়িম্মাহ ও ‘উলামায়ে কিরামের অনেকের মতে ১২ই যিলহাজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আর কারো কারো মতে ১৩ই যিলহাজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ক্বোরবানী করতে হবে। এই সময়ের আগে বা পরে ক্বোরবানী করলে ক্বোরবানী আদা হবে না। সাহীহ্‌ বুখারীতে বারা ইবনু ‘আযিব 3 হতে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

مَنْ ذَبَحَ قَبْل الصلوة فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَيْءٍ.رواه البخاري- ٥٥٤٥. و مسلم- ١٩٦١

অর্থ- যে ব্যক্তি ‘ঈদের সালাতের পূর্বে যবেহ্ করবে, তাহলে সেটা হবে নিজের পরিবারের খাবারের জন্য পেশকৃত গোশ্‌ত। এতে ক্বোরবানীর আদৌ কিছু নেই (অর্থাৎ এটা আদৌ ক্বোরবানী হিসেবে গণ্য হবে না)।সাহীহ্‌ বুখারী- ৫৫৪৫। সাহীহ্‌ মুছলিম- ১৯৬১

সাহীহ্‌ বুখারী ও সাহীহ্‌ মুছলিমে জুনদুব ইবনু ছুফইয়ান আল বুজালী 3 থেকে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ فَلْيُعِدْ مَكَانَهَا أُخْرَىرواه البخاري- ٢٥٦٢. و مسلم- ١٩٦٠

অর্থ- সালাতের (‘ঈদের সালাতের) পূর্বে যে ব্যক্তি যবেহ্‌ করবে, সে যেন তদস্থলে অন্য একটি পশু ক্বোরবানী করে।সাহীহ্‌ বুখারী- ২৫৬২। সাহীহ্‌ মুছলিম- ১৯৬০

আনাছ ইবনু মালিক 3 হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلَاةِ ، فَإِنَّمَا ذَبَحَ لِنَفْسِهِ ، وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلَاةِ ، فَقَدْ تَمَّ نُسُكُهُ وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ.رواه البخاري- ٥٥٤٦,٥٥٤٥

অর্থ- যে ব্যক্তি নামাযের পূর্বে (‘ঈদের নামাযের পূর্বে) যাবেহ্‌ করল, সে তা নিজের জন্য যবেহ্‌ করল। আর যে ব্যক্তি নামাযের পরে যবেহ্‌ করল, তার ক্বোরবানী পূর্ণ হলো এবং সে মুছলমানদের পথ সঠিকভাবে অনুসরণ করল।সাহীহ্‌ বুখারী- ৫৫৪৫, ৫৫৪৬১০

উপরোক্ত হাদীছসমূহ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ‘ঈদের সালাতের আগে ক্বোরবানী করলে তা আদা হবে না বরং পুনরায় ক্বোরবানী করতে হবে। তবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল যেখানে ‘ঈদের জামা‘আতের কোন ব্যবস্থা নেই, সেসব এলাকায় সূর্য উদয়ের পর ‘ঈদের সালাত আদায় করা যায় এই পরিমাণ সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর ক্বোরবানী করা জায়িয।

ক্বোরবানীর শেষ সময় ১২ই যিলহাজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত মোট তিন দিন না ১৩ই যিলহাজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত মোট চার দিন, এ বিষয়ে যদিও ‘উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, তবে ক্বোরআন ও ছুন্নাহ্‌র দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে ৪ দিনের পক্ষের মতটিই অধিকতর শক্তিশালী ও বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত। কেননা ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:-

وَاذْكُرُواْ اللّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍسورة البقرة- ٢٠٣১১

অর্থাৎ- এবং নির্ধারিত দিনসমূহে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করো।ছূরা আল বাক্বারাহ- ২০৩১২

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:-

لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ.سورة الحج- ٢٨১৩

অর্থাৎ- যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলিতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ পশু হতে যা রিয্‌ক্ব হিসেবে দান করেছেন, সেগুলোর উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করতে পারে।ছূরা আল হাজ্জ- ২৮১৪

নুবাইশাহ আল হুযালী 3 হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

أَيَّامُ التَّشْرِيقِ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ وَذِكْرِ اللَّهِ تعالى.رواه مسلم- ١١٤١১৫

অর্থ- তাশরীক্বের দিনগুলো হলো খানা-পিনা ও আল্লাহ্‌র যিক্‌র তথা আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার দিন।সাহীহ্‌ মুছলিম- ১১৪১১৬

উপরোক্ত আয়াতদ্বয় ও হাদীছে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার মধ্যে পশু জবাইকালীন আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করা তথা আল্লাহ্‌র নামে পশু যবেহ্‌ করাও অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া যেহেতু রাছূলুল্লাহ 1 এর উপরোক্ত হাদীছের ভিত্তিতে সকল আয়িম্মায়ে কিরাম এ বিষয়ে একমত যে, আইয়্যামে তাশরীক্বের দিনগুলোতে রোযা রাখা হারাম। তাই এ বিষয়টিও ৪ দিনব্যাপী ক্বোরবানী জায়িয হওয়ার মতামতকে জোরালোভাবে সমর্থন করে। তবে প্রথম দিন অর্থাৎ ১০ই যিলহাজ্জ ‘ঈদের সালাত খুতবাহ্‌সহ সম্পন্ন হওয়ার পর ক্বোরবানী করাই যে সবচেয়ে উত্তম এবং তৎপরবর্তী দিনগুলোর পর্যায়ক্রমে পরের দিনের চেয়ে আগের দিন (যেমন- ১২ তারিখের চেয়ে ১১ তারিখ) ক্বোরবানী করা উত্তম, এ বিষয়ে আয়িম্মায়ে কিরামের কারো কোন দ্বিমত নেই। এমনিভাবে রাতের চেয়ে দিনের বেলা ক্বোরবানী করাটাই যে উত্তম এবং ৯ই যিলহাজ্জ দিবাগত রাতে এবং ১৩ই যিলহাজ্জ দিবাগত রাতে ক্বোরবানী করলে তা যে আদা হবে না, এতদ্বিষয়েও আয়িম্যায়ে কিরামের কারো কোন দ্বিমত নেই।

যাই হোক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্বোরবানী দেয়ার এই শর্তটি কেবল ক্বোরবানীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ‘আক্বীক্বাহ বা হাদ্‌ইয়ু ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

ক্বোরবানীর জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো উট, এরপর গরু, এরপর ভেড়া-দুম্বা বা ছাগল। তারপর উটের এক-সপ্তমাংশ, এরপর গরুর এক-সপ্তমাংশ। আর এসবের নারী প্রজাতি থেকে পুরুষ প্রজাতি হলো উত্তম। সাহীহ্‌ বুখারী ও সাহীহ্‌ মুছলিমে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, জুমু‘আর সালাতের জন্য দ্রুত গমনকারীদের সম্পর্কে রাছূলুল্লাহ 1 বলেছেন:-

مَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الْأُولَى، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَدَنَةً وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّانِيَةِ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَقَرَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّالِثَةِ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ كَبْشًا.رواه البخاري- ٨٨١ . و مسلم- ٨٥٠১৭

অর্থ- যে ব্যক্তি জুমু‘আর প্রথম মূহুর্তে গমন করল সে যেন একটি উষ্ট্রী ক্বোরবানী করল, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দ্বিতীয় মূহুর্তে গমন করল সে যেন একটি গাভী ক্বোরবানী করল, আর যে ব্যক্তি জুমু‘আর তৃতীয় মূহুর্তে তথা তৃতীয় ভাগে গমন করল সে যেন একটি ছাগল ক্বোরবানী করল।সাহীহ্‌ বুখারী- ৮৮১। সাহীহ্‌ মুছলিম- ৮৫০১৮

এই হাদীছ দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, গরু থেকে উট উত্তম এবং ছাগল থেকে গরু উত্তম। আর যেহেতু গরু থেকে উট উত্তম সুতরাং গরুর এক-সপ্তমাংশ থেকে উটের এক-সপ্তমাংশ উত্তম হবে, এটাই স্বাভাবিক।

উট, গরু, ছাগল- এই তিন প্রজাতির মধ্যে যেটি বেশি দামী, মোটা-তাজা, দেখতে সুন্দর ও নিখুঁত হবে, ঐ প্রজাতির মধ্যে সেটিই হবে সবচেয়ে উত্তম। যেমন- যে উটটি বেশি দামী, মোটা-তাজা ও নিখুঁত হবে- উটের মধ্যে সেটিই হবে সবচেয়ে উত্তম। এমনিভাবে গরু-ছাগল-ভেড়ী বা দুম্বার মধ্যে যেটি বেশি দামী, মোটা-তাজা ও নিখুঁত হবে- এ প্রজাতির পশুর মধ্যে সেটিই হবে ক্বোরবানীর জন্য সবচেয়ে উত্তম। আবূ রাফে‘ 3 হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:-

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا ضَحَّى اشْتَرَى كَبْشَيْنِ سَمِينَيْنِ.رواه أحمد- ٢٢٠ /٦.  وابن ماجة- ٣١٢٢১৯

অর্থ- রাছূলুল্লাহ 1 যখন ক্বোরবানী করতে যেতেন, তখন তিনি দু’টি মোটা-তাজা মেষ (দুম্বা) ক্রয় করতেন।মুছনাদে ইমাম আহ্‌মাদ- ৬/২২০। ইবনু মাজাহ- ৩১২২২০

ক্বোরবানী সংক্রান্ত অত্যন্ত জরুরী কয়েকটি মাছায়িল:-

১) বেশি মূল্যে ক্বোরবানীর জন্য একটি পশু কেনার চেয়ে সম্ভব হলে ঐ একই দামে একই প্রজাতির একাধিক পশু ক্বোরবানী করা উত্তম। কেননা একাধিক ক্বোরবানীর দ্বারা অধিক এবং একাধিক বার রক্ত প্রবাহিত করা হয়ে থাকে। তবে সাতটি ছাগল-ভেড়া বা দুম্বা ক্বোরবানীর চেয়ে একটি উট বা গরু ক্বোরবানী করা উত্তম। কেননা এগুলোর সাতটি হলো একটি উট বা গরুর সমান, আর পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, ক্বোরবানীর জন্য সবচেয়ে উত্তম হলো- উট, এরপর গরু, তারপর দুম্বা-ছাগল ও ভেড়া। সর্বাবস্থায় খেয়াল রাখতে হবে- পশুটি যেন ত্রুটিমুক্ত হয়। 

এমনিভাবে প্রত্যেক প্রজাতির পশুর মধ্যে উত্তম জাতের পশু ক্বোরবানী করা হলো- সর্বোত্তম। যেমন- উটের মধ্যে দামী ভালো জাতের উট, তদ্রুপ গরু-ছাগল-ভেড়া-দুম্বা ইত্যাদির মধ্যেও ভালো জাতের দামী পশু ক্বোরবানী করা সবচেয়ে উত্তম।

২) ক্বোরবানীর জন্য নিখুঁত ও নির্দোষ পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোন ত্রুটি বা দোষ দেখা দেয়, যে দোষ বা ত্রুটি সম্বলিত পশু ক্বোরবানী করা জায়িয নয়, মোটকথা যদি পশুটি ক্বোরবানীর অনুপযোগী হয়ে যায়, যেমন- একটি ভালো উট, গরু, দুম্বা, ছাগল বা ভেড়া কেনার পর যদি সেটি অন্ধ, খোঁড়া বা অচল হয়ে যায় কিংবা পা ভেঙে যায়, তাহলে এক্ষেত্রে এর কারণ খুঁজে দেখতে হবে। যদি দেখা যায় যে, ক্বোরবানী দাতার উদাসীনতা বা গাফলতির কারণে কিংবা তার সুস্পষ্ট ভুলের কারণে এমনটি হয়েছে, তাহলে উক্ত পশু দ্বারা ক্বোরবানী আদা হবে না, বরং এর স্থলে তাকে একই প্রজাতির সমমূল্যের অন্য একটি পশু ক্বোরবানী করতে হবে। কেননা ক্বোরবানীর পশু ক্রয় করার পর ক্রেতা তথা ক্বোরবানী দাতা সেটির আমানতদার ও যিম্মাহ্‌দার হয়ে যান, সুতরাং তার যিম্মায় থাকাকালীন যদি পশুটি তার অবহেলা বা ভুলের কারণে ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে অবশ্যই তাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে এ বিধানটি কেবল ওয়াজিব ক্বোরবানীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আর যদি মুছ্‌তাহাব ক্বোরবানীর পশুর ক্ষেত্রে এরূপ ঘটে থাকে, তাহলে এরকম পশুর স্থলে অন্য একটি পশু ক্বোরবানী করা যদিও ওয়াজিব নয়, তবে তা মুছ্‌তাহাব তথা উত্তম।

আর যদি ক্রেতা তথা ক্বোরবানী দাতার অবহেলা বা সুস্পষ্ট ভুলের কারণে এরূপ না হয়ে থাকে, বরং অন্য কোন কারণে কিংবা এমনিতে হয়ে থাকে, তাহলে ক্বোরবানী ওয়াজিব হোক বা মুছ্‌তাহাব হোক সর্বাবস্থায় এরূপ পশু দ্বারা ক্বোরবানী আদা করা জায়িয রয়েছে। কেননা ক্রেতা পশুটি ক্রয় করার সময় নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত দেখেই কিনেছে, আর পরবর্তীতে যা হয়েছে তাতে ক্রেতার কোন হাত নেই, সুতরাং তজ্জন্য ক্রেতাকে দায়ী করা যাবে না এবং তার উপর কোন দায়ভার বর্তাবে না। শারী‘য়াতের বিধান হলো- আমানতদারের কোনরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতীত যদি আমানত নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তজ্জন্য আমানতদারকে দায়ী করা যাবে না।

৩) ক্বোরবানীর জন্য পশু নির্ধারণ করতে হবে। আর এই নির্ধারণ দু’ভাবে করা যায়- (ক) কথা দ্বারা। যেমন-কেউ যদি একটি পশু ক্রয় করার পর এরূপ বলে যে, “এটি হলো আমার ক্বোরবানীর পশু” আর এ কথা দ্বারা যদি তার উদ্দেশ্য হয় পশুটিকে ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট করা, তাহলে এরূপ কথা ও নিয়্যাতের দ্বারা পশুটি ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং তখন থেকে পশুটি ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য হয়। তবে যদি “এটি হলো ক্বোরবানীর পশু” বলে এটিকে ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারণ বা সুনির্দিষ্ট করা উদ্দেশ্য না হয় বরং শুধুমাত্র এই মর্মে অবগত করা উদ্দেশ্য হয় যে, ভবিষ্যতে আমি পশুটি ক্বোরবানী দেয়ার ইচ্ছা রাখি, তাহলে এরূপ নিয়্যাত ও কথা দ্বারা পশুটি ক্বোরবানীর জন্য সুনির্দিষ্ট বা সুনির্ধারিত হবে না কিংবা ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য হবে না।

(খ) কাজের দ্বারা সুনির্দিষ্টকরণ। এটি দু’ভাবে করা যেতে পারে- (এক) ক্বোরবানীর নিয়্যাতে পশুটি যবেহ্‌ করা। যখন কেউ ক্বোরবানীর যোগ্য কোন পশুকে ক্বোরবানীর নিয়্যাতে যবেহ্‌ করে নিবে, তখন যবেহ্‌কৃত পশুটি ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য হবে এবং তার উপর ক্বোরবানীর পশুর যাবতীয় বিধি-বিধান প্রযোজ্য হবে।

(দুই) ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত পশুর স্থলে ক্বোরবানী দেয়ার উদ্দেশ্যে অন্য একটি পশু ক্রয় করা। যেমন- ক্বোরবানীর জন্য একটি পশু নির্ধারণ করার পর পশুটি ক্বোরবানী দাতার অবহেলা বা ভুলের দরুণ হারিয়ে যাওয়ার কিংবা ক্বোরবানীর অযোগ্য হয়ে পড়ার কারণে যদি তদস্থলে বা তার পরিবর্তে অন্য একটি পশু ক্রয় করা হয়, তাহলে হারিয়ে যাওয়া বা অযোগ্য হয়ে যাওয়া পূর্ববর্তী পশুটির স্থলবর্তী হিসেবে ক্রয়কৃত পশুটি ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য ও নির্ধারিত হয়ে যায়। কেননা পরিবর্তিত বিষয় বা বস্তুর উপর যে বিধান প্রযোজ্য ছিল, তার স্থলাভিষিক্ত বিষয় বা বস্তুর উপর সেই একই বিধান প্রযোজ্য হয়ে থাকে।

যেহেতু হারিয়ে যাওয়া বা অযোগ্য হয়ে পড়া পশুটি ক্বোরবানীর পশু বলে নির্ধারিত ছিল এবং তার উপর ক্বোরবানীর পশুর বিধান প্রযোজ্য ছিল, অতএব তার স্থলাভিষিক্ত তথা তার পরিবর্তে ক্রয়কৃত পশুটি ক্বোরবানীর পশু বলেই গণ্য হবে এবং ঐ পশুটির ক্ষেত্রে যেসব বিধান প্রযোজ্য ছিল তার স্থলাভিষিক্ত এই পশুটির ক্ষেত্রেও সেইসব বিধান প্রযোজ্য হবে।

তবে এছাড়া (ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট পশুর স্থলে বা পরিবর্তে ক্রয়কৃত পশু ব্যতীত) অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ক্বোরবানীর নিয়্যাতে কোন পশু কেবল ক্রয় করলেই সেটি ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত হবে না এবং সেটি ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না নির্ধারণ করার উপরোল্লিখিত নিয়মাবলির যে কোন একটি নিয়ম অনুসরণ করা হবে।

যেমন- একজন দাসকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে কেবল ক্রয় করলেই সেই দাস মুক্ত দাস বলে গণ্য হয় না এবং তার উপর মুক্ত দাসের বিধান প্রযোজ্য হয় না, যতক্ষণ না তাকে মুক্ত করা হয় কিংবা তার মুক্ত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত হয়।

এমনিভাবে কোন কিছু ওয়াক্বফ্‌ করার উদ্দেশ্যে কেবল ক্রয় করলেই তা ওয়াক্বফ্‌কৃত বলে গণ্য হয় না এবং তার উপর ওয়াক্বফের বিধান প্রযোজ্য হয় না, যতক্ষণ না সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিতভাবে তা ওয়াক্বফ্‌ করা হয়। তদ্রুপ একটি পশু কেবল ক্বোরবানীর নিয়্যাতে ক্রয় করলেই সেটি ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না সেটিকে সুবিধিত নিয়মে ক্বোরবানীর জন্য সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত করা হবে।

যখন একটি পশু ক্বোরবানীর জন্য নির্ধারিত হয়ে যাবে এবং ক্বোরবানীর পশু বলে গণ্য হয়ে যাবে, তখন পশুটির ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে:-

১) পশুটিকে ক্বোরবানীর পরিপন্থি কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে  না। যেমন- এটিকে দান বা বিক্রি করা যাবে না কিংবা বন্ধক রাখা যাবে না। মোটকথা, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে পশুটিকে ব্যবহার কিংবা পশুটির বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

যেমন- কেউ যদি ক্বোরবানীর জন্য একটি উট, গরু বা ছাগল নির্ধারণ করে নেয়ার পর নির্ধারিত ঐ পশুটির প্রতি যে কোন কারণে তার মন আকৃষ্ট হয়ে যায় এবং সে এই পশুটিকে ক্বোরবানী না দিয়ে এটিকে নিজের জন্য রেখে দিতে চায় এবং পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম অন্য একটি পশু ক্বোরবানী দিতে চায়, তাহলে এরূপ করা তার জন্য জায়িয নয়। কেননা এটা হলো আল্লাহ্‌র (0) জন্যে নির্ধারণকৃত বস্তুকে নিজের জন্য ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

তবে হ্যাঁ, আদৌ নিজের ব্যক্তিগত কোন কারণে বা স্বার্থে নয় বরং নিছ্‌ক ক্বোরবানীর স্বার্থে এবং একমাত্র আল্লাহ্‌র (7) সন্তুষ্টির নিমিত্ত যদি নির্ধারিত পশুটির পরিবর্তে এর থেকে উত্তম কোন পশু নেয়া হয়, তাহলে তাতে কোন অসুবিধা নেই।

২) ক্বোরবানীর জন্য একটি পশু নির্ধারণ করার পর যদি নির্ধারণকারী মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য আবশ্যক হলো নির্ধারিত পশুটি ক্বোরবানী করা। আর যদি নির্ধারণ করার পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে উত্তরাধিকারীগণ পশুটিকে তাদের ইচ্ছানুযায়ী ভোগ-ব্যবহার করতে পারবেন।

৩) ক্বোরবানীর জন্য কোন পশু নির্ধারণ করার পর সেই পশু থেকে কোনরূপ ফায়দা নেয়া যাবে না এবং পশুটিকে একমাত্র ক্বোরবানী ব্যতীত অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন- পশুটি দ্বারা হাল-চাষ করা যাবে না, তার দুধ দোয়ানো যাবে না যদি তাতে তার কিংবা বাচ্চার কোন ক্ষতি হয়। তার লোম বা পশম কাটা যাবে না। তবে যদি পশুটির কোন উপকার হয় তাহলে তার লোম কাটা যাবে, তার দুধ দোয়ানো যাবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো- দুধ বা লোম বিক্রয়লব্ধ টাকা অবশ্যই সাদাক্বাহ্‌ বা হাদ্‌ইয়াহ্‌ হিসেবে দিয়ে দিতে হবে, তদ্বারা নিজে উপকৃত হওয়া যাবে না।

৪) ক্বোরবানীর জন্য পশু নির্ধারণ করার পর যদি সেটি মারা যায় বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে এক্ষেত্রে দুই অবস্থা:-

(ক) যদি ক্বোরবানী দাতার অবহেলা বা ভুল ইত্যাদি কারণে, মোটকথা ক্বোরবানী দাতার কোন কর্মকান্ডের কারণে যদি মরে যায় কিংবা হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে সমমানের-সমমূল্যের কিংবা এর থেকে উত্তম অন্য একটি পশু ক্বোরবানী করা ওয়াজিব। পরবর্তীতে হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হয়ে যাওয়া পশুটি যদি পাওয়া যায়, তাহলে এর মালিক হবেন- ক্বোরবানীদাতা। তিনি এটিকে দান, বিক্রি, সাদাক্বাহ্‌ ইত্যাদি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবেন।

(খ) যদি ক্বোরবানী দাতার অবহেলা বা ভুলের কারণে নয় কিংবা তার কোন ক্রিয়া-কর্মের দরুণ নয় বরং অন্য কোন কারণে এরূপ কিছু ঘটে থাকে, তাহলে তাকে উক্ত পশুটির স্থলে অন্য আরেকটি পশু ক্বোরবানী করতে হবে না। কেননা পশুটি তার কাছে আমানত স্বরূপ ছিল। আর আমানত যদি এমনিতে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে যার কাছে বস্তুটি আমানত থাকে তার উপর কোন জামানত তথা ক্ষতিপূরণ বর্তায় না। তবে পরবর্তীতে যদি পশুটি কোনভাবে ফিরে পাওয়া যায়, তাহলে ক্বোরবানীর সময় চলে গেলেও পাওয়ার সাথে সাথে সেটি ক্বোরবানীর নিয়মে যবেহ্‌ করে দেয়া ওয়াজিব।

আর যদি ক্বোরবানীর জন্য পশু সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত করার আগেই কারো উপর ক্বোরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকে, যেমন কেউ যদি মানত করে থাকে যে, “এ বছর আমি ক্বোরবানী করব” আর এমতাবস্থায় তার ক্রয়কৃত পশুটি যদি তার কারণে নয় বরং অন্য এমন কোন কারণে মরে যায় বা চুরি হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়; যে কারণের পিছনে তার কোন হাত নেই বা তার কিছু করার সাধ্য নেই, তাহলে এমতাবস্থায়ও তার উপর ওয়াজিব হলো- অন্য একটি পশু ক্বোরবানী করা। পরবর্তীতে যদি সে তার এই হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হয়ে যাওয়া পশুটি কোনভাবে ফিরে পায়, তাহলে সে মালিক হবে পশুটির এবং ইচ্ছানুযায়ী সে এটি ভোগ-ব্যবহার করতে পারবে। তবে এর স্থলে যে পশুটি ক্বোরবানী করেছিল সেটির মূল্য যদি পূর্বের হারিয়ে যাওয়া পশুটির মূল্য থেকে কম হয়ে থাকে, তাহলে যে পরিমাণ কম হবে সেই পরিমাণ মূল্য সাদাক্বাহ করে দিতে হবে।

সূত্র:- শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ্‌ আল ‘উছাইমীন সংকলিত “আহ্‌কামুল উযহিয়াহ ওয়ায্‌ যাকাত”।

শাইখ সালিহ্‌ ইবনু ‘আব্দিল ‘আযীয আ-ল আশ্‌ শাইখ সংকলিত “আহ্‌কামুল হাদয়ি ওয়াল আযা-হী”।

বি: দ্র: যবেহ্‌ করার নিয়ম-পদ্ধতিসহ ক্বোরবানী সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু জরুরী মাছায়িল ইন-শা-আল্লাহ আগামী ‘ঈদুল আযহা সংখ্যায় প্রকাশের আশা রাখি। এই সংখ্যাটি সযত্নে সংগ্রহে রাখুন!


১. سورة الحج- ٣٤ 
২. ছূরা আল হাজ্জ- ৩৪ 
৩. رواه الترمذي-١٤٩٧. وأبو داؤد- ٢٨٠٢ . وابن ماجة- ٣١٤٤ 
৪. তিরমিযী- ১৪৯৭। আবূ দাঊদ- ২৮০২। ইবনু মাজাহ্‌- ৩১৪৪ 
৫. رواه البخاري- ٥٥٤٥. و مسلم- ١٩٦١ 
৬. সাহীহ্‌ বুখারী- ৫৫৪৫। সাহীহ্‌ মুছলিম- ১৯৬১ 
৭. رواه البخاري- ٢٥٦٢. و مسلم- ١٩٦٠ 
৮. সাহীহ্‌ বুখারী- ২৫৬২। সাহীহ্‌ মুছলিম- ১৯৬০ 
৯. رواه البخاري- ٥٥٤٦,٥٥٤٥ 
১০. সাহীহ্‌ বুখারী- ৫৫৪৫, ৫৫৪৬ 
১১. سورة البقرة- ٢٠٣ 
১২. ছূরা আল বাক্বারাহ- ২০৩ 
১৩. سورة الحج- ٢٨ 
১৪. ছূরা আল হাজ্জ- ২৮ 
১৫. رواه مسلم- ١١٤١ 
১৬. সাহীহ্‌ মুছলিম- ১১৪১ 
১৭. رواه البخاري- ٨٨١ . و مسلم- ٨٥٠ 
১৮. সাহীহ্‌ বুখারী- ৮৮১। সাহীহ্‌ মুছলিম- ৮৫০ 
১৯. رواه أحمد- ٢٢٠ /٦.  وابن ماجة- ٣١٢٢ 
২০. মুছনাদে ইমাম আহ্‌মাদ- ৬/২২০। ইবনু মাজাহ- ৩১২২ 

Subscribe to our mailing list

* indicates required
Close