আউলিয়া কারা? আশ্‌শাইখ ‘আব্দুর্‌ রায্‌যাক্ব ইবনু ‘আব্দিল মুহ্‌ছিন আল ‘আব্বাদ আল বাদ্‌র حَفِظَهُ اللهُ

بسم الله الرحمن الرحيم

নিশ্চয় সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র (0)। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি,তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি,তাঁর নিকটই ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। আমরা আল্লাহ্‌র (0) নিকট আমাদের নাফ্‌ছের অনিষ্ট থেকে এবং আমাদের কর্মের মন্দ কুফল থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যাকে হিদায়াত করেন তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই, আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তাকে হিদায়াত করার কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে,আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। তিনি একক,তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,মুহাম্মাদ 1 আল্লাহ্‌র বান্দাহ ও রাছূল। তিনি হলেন আল্লাহ্‌র বাছাইকৃত,তাঁর অতি প্রিয় এবং তাঁর অহীর উপর (মানবজাতির জন্য রাছূলুল্লাহ 1 এর প্রতি নাযিলকৃত আল্লাহ্‌র বার্তার বিষয়ে) অত্যন্ত বিশ্বস্থ এবং মানবজাতিকে আল্লাহ্‌র শারী‘য়াত তথা তাঁর প্রবর্তিত বিধান পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত।
তিনি (রাছূলুল্লাহ 1) মানবজাতির জন্য কল্যাণকর এমন কোন বিষয় অবশিষ্ট রাখেননি,যা তিনি তাঁর উম্মাতকে অবহিত করেননি এবং এমন কোন অনিষ্টকর বিষয় অবশিষ্ট রাখেননি,যা থেকে তিনি স্বীয় উম্মাতকে সতর্ক করেননি। তিনি প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ঠভাবে পৌঁছিয়েছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ্‌র পথে প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন।

আল্লাহ্‌র অগণিত সালাত ও ছালাম বর্ষিত হোক রাছূলুল্লাহ্‌র প্রতি,তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবাগণের প্রতি।
অতঃপর ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:—

أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ. اَلَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ.

অর্থাৎ-জেনে রাখো! নিশ্চয় আল্লাহ্‌র অলীগণের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেন না। তারা হলেন সেই সব লোক যারা ঈমান আনেন এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করেন।ছূরা ইঊনুছ -৬২-৬৩

এখানে এমন একটি প্রশ্ন রয়েছে,যার উত্তর সকল ঈমানদারের জানা উচিত, তারপর প্রত্যেক মূমিনের উচিত এই উত্তরটি নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া।

প্রশ্নটি হলো – কারা আল্লাহ্‌র সেইসব অলী বা বন্ধু;যাদের জন্য কোন ভয় নেই,চিন্তা নেই?
এই প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ 0 পরবর্তী আয়াতে এই বলে দিয়েছেন-

اَلَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ

অর্থাৎ-তারা (আল্লাহ্‌র অলী) হলেন সেই সকল লোক যারা ঈমান এনেছেন এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করেছেন।
অতএব,যে ব্যক্তি ঈমানদার ও মুত্তাক্বী (তাক্বওয়া অবলম্বনকারী) হবেন, তিনিই হবেন আল্লাহ্‌র অলী। ওয়ালায়াত (বেলায়াত) বা আল্লাহ্‌র বন্ধুত্ব লাভের মূল উপায় হলো – ঈমান ও তাক্বওয়া।
“ঈমান ও তাক্বওয়া” এ দু’টি বিষয় যখন একই বাক্যে উল্লেখ করা হয়, তখন ঈমান দ্বারা আল্লাহ 0 ও তাঁর রাছূলের

(1) আনুগত্যমূলক কাজ সম্পাদনকে বুঝায় এবং তাক্বওয়া দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের নিষেধকৃত বিষয়াদী বর্জনকে বুঝায়। তাই প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহ্‌র অলী,তারা আল্লাহ 0 ও তাঁর রাছূলের (1) আদেশকৃত বিষয়াদী যথাযথভাবে পালন করে থাকেন এবং তাদের নিষেধকৃত বিষয়বস্তু সম্পূর্ণরূপে পরিহার ও বর্জন করে থাকেন।

আল্লাহ্‌র আদেশকৃত কর্মগুলো হলো-ফার্‌য বা আবশ্যকীয় এবং মুছ্তাহাব্ব বা পছন্দনীয়, আর আল্লাহ্‌র (0) নিষেধকৃত কর্মসমূহ হলো – হারাম ও মাকরূহ।
সুতরাং আল্লাহ্‌র অলী হলেন প্রকৃত অর্থে তারা,যারা তাঁর আদেশকৃত বিষয়াদী পালনের মাধ্যমে এবং তাঁর নিষেধকৃত বিষয়াদী বর্জনের মাধ্যমে ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্ব প্রমাণ ও বাস্তবায়ন করে থাকেন।
তাই আল্লাহ্‌র আদেশকৃত বিষয়াদী পালনের ক্ষেত্রে যিনি কেবল ফার্‌যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র (0) নির্দেশিত ফার্‌য-ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় বিধানসমূহ সম্পাদন করবেন, আর আল্লাহ্‌র নিষিদ্ধ বিষয়াদী বর্জনের ক্ষেত্রে যারা কেবল হারাম বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, অর্থাৎ শুধুমাত্র হারাম বিষয়বস্তু বর্জন করে চলবেন, তাহলে তাদের সাথে আল্লাহ্‌র (0) অলীত্ব বা বন্ধুত্বের স্তর হবে মুক্বতাসিদূনের স্তর। অর্থাৎ সে মুক্বতাসিদ (ইকোনমী বা মধ্যম) স্তরের অলী বলে গণ্য হবে।

পক্ষান্তরে যিনি ফার্‌য-ওয়াজিব তথা আল্লাহ্‌র আদেশকৃত আবশ্যকীয় বিষয়াদী পালনের পর মুছ্তাহাব্ব বা আল্লাহ্‌র পছন্দনীয় বিষয়াদী পালনের মাধ্যমে এবং হারাম বিষয়াদী বর্জনের পর মাকরূহ বা আল্লাহ্‌র নিকট অপছন্দনীয় বিষয়াদী বর্জনের মাধ্যমে নিজের অবস্থা আরো উচ্চ স্তরে নিয়ে যাবেন, তাদের সাথে আল্লাহ্‌র ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্বের স্তর হবে ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত বা কল্যাণের কাজে অগ্রগামীদের স্তর বা মর্যাদা। আর এটিই হলো বন্ধুত্বের সবচেয়ে মহান ও সর্বোচ্চ স্তর।

অতএব এ বিষয়টি জেনে রাখা উচিত যে, ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্বের স্তর হলো— দু’টি। একটি হলো- মুক্বতাসিদূনের স্তর, অপরটি হলো মুক্বার্‌রাবূন (নৈকট্যশীল) বা ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত (কল্যাণের কাজে অগ্রগামীদের) স্তর। আর এই উভয় স্তরের অধিকারীগণই ক্বিয়ামাতের দিন কোনরূপ হিসাব ও শাস্তি ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
এই দু’টি উচ্চ স্তরের অধিকারীগণের সুস্পষ্ট বিবরণ এসেছে সাহীহ্‌ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীছে। আবূ হুরাইরাহ 3 থেকে বর্ণিত এ হাদীছটি ‘উলামায়ে কিরামের নিকট হাদীছে অলী বলেই বহুল পরিচিত।
কেননা এই হাদীছে অলী কারা? তাদের স্তর বা মর্যাদা কী? তাদের জন্য কী ছাওয়াব বা প্রতিদান রয়েছে? এসব বিষয়ের বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। এটি একটি মহান হাদীছে ক্বোদছী, যাতে রাছূলুল্লাহ 1 থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ (0) বলেছেন:—

مَنْ عَادٰى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِيْ بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا اِفْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِيْ يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتّٰى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِيْ يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِيْ يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِيْ يَمْشِيْ بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اِسْتَعَاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ

অর্থঃ- যে ব্যক্তি আমার অলীর শত্রুতা করবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। ফার্‌য ‘ইবাদাতের চেয়ে আমার নিকট অধিক পছন্দনীয় এমন কোন বস্তু নেই যদ্বারা আমার বান্দাহ আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে। আর আমার বান্দাহ সব সময় নাফ্‌ল ‘ইবাদাতের দ্বারা আমার (অধিক) নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে যে পর্যন্ত না আমি তাকে ভালোবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালোবেসে নেব, তখন আমি তার কর্ণ হয়ে যাব যদ্বারা সে শুনতে পাবে, আমি তার চক্ষু হয়ে যাব যদ্বারা সে দেখতে পাবে, আমি তার হাত হয়ে যাব যদ্বারা সে ধরতে পারবে এবং পা হয়ে যাব যদ্বারা সে চলাফেরা করবে। তখন সে যদি আমার নিকট কোন কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই আমি তাকে তা দান করব, সে যদি আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেব।সাহীহুল বুখারী
এই হাদীছে ক্বোদছীতে আল্লাহ 0 আহলুল ওয়ালায়াত বা আল্লাহ্‌র বন্ধুত্ব লাভকারীদের কথা এবং তাদের দু’টি স্তরের কথা বর্ণনা করেছেন।
প্রথম স্তরের বর্ণনা রয়েছে উক্ত হাদীছে বর্ণিত আল্লাহ্‌র (0) এই কথাটিতে-

مَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِيْ بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا اِفْتَرَضْتُ عَلَيْهِ

অর্থ – আমার ফার্‌যকৃত ‘আমাল বা ‘ইবাদাতের মাধ্যমে আমার বান্দাহ্‌ আমার নৈকট্য কামনা করবে, এটা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।
আল্লাহ 0 বান্দাহ্‌র উপর আবশ্যক বা ফার্‌য করে দিয়েছেন তাঁর নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কাজগুলো সম্পাদন করা এবং তাঁর নিষেধকৃত হারাম কাজগুলো বর্জন করা। তাই যে ব্যক্তিকে আল্লাহ 0 ওয়াজিব কাজগুলো পালনে এবং হারাম কাজগুলো বর্জনে তাওফীক্ব ও সাহায্য প্রদান করে থাকেন, তিনিই আল্লাহ্‌র অলীগণের অন্তভুর্ক্ত বলে গণ্য হবেন এবং তিনিই আল্লাহ্‌র মুক্বতাসিদ বান্দাহ বলে গণ্য হবেন।
মুক্বতাসিদ হলেন তিনি, যিনি ফার্‌য-ওয়াজিব কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পাদন করে থাকেন এবং হারাম বা নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিপূর্ণরূপে বর্জন করে থাকেন।

দ্বিতীয় স্তর:-এটি হলো সর্বোচ্চ স্তর। এটি হলো ‘‘ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত’’ বা উত্তম কাজে অগ্রগামীদের স্তর। এদের বর্ণনা দিতে যেয়ে উপরোক্ত হাদীছে ক্বোদছীতে আল্লাহ 0 বলেছেন:-

وَمَا يَزَالُ عَبْدِيْ يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتّٰى أُحِبَّهُ

অর্থ- ফার্‌য-ওয়াজিব ‘আমাল সম্পাদনের পর আমার বান্দাহ সব সময় নাফ্‌ল ‘আমাল-‘ইবাদাত পালনের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে, যে পর্যন্ত না আমি তাকে ভালোবাসি।

অর্থাৎ- ভালো ও কল্যাণের পথে অগ্রগামী আল্লাহ্‌র (0) মুক্বার্‌রাব বা নৈকট্যশীল বান্দাহ; সে ফার্‌য—ওয়াজিব ‘ইবাদাত সমূহ সঠিক ও যথাযথভাবে সম্পাদনে সচেষ্ট ও পরিপূর্ণ যত্নশীল হওয়ার সাথে সাথে উত্তম ঈর্ষণীয় এবং আল্লাহ্‌র পছন্দনীয় মুছতাহাব্ ‘আমাল-‘ইবাদাত সমূহ পালনে সচেষ্ট হবে, যাতে সে উঁচু স্তর ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারে এবং আল্লাহ্‌র (0) ভালোবাসা লাভে ধন্য হতে পারে।
অতঃপর উক্ত হাদীছে ক্বোদছীতে আল্লাহ 0 বলেছেন:-

فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِيْ يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِيْ يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِيْ يَمْشِيْ بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اِسْتَعَاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ

অর্থাৎ, এভাবে বান্দাহ যখন আমার ভালোবাসা অর্জন করে নেবে, আমি তাকে আমার প্রিয় বান্দাহ বা অলী হিসেবে গ্রহণ করে নেবো। (বান্দাহ যখন আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ ভালোবাসা অর্জন করে তাঁর নৈকট্যলাভকারী বন্ধু হয়ে যাবে) তখন তার (বান্দাহ্‌র) দু‘আ হবে আমার নিকট গৃহীত বা মাক্ববূল। সে যদি আমার কাছে প্রার্থনা করে তাহলে অবশ্যই আমি তাকে সেটা দান করব। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দিব।

মোট কথা বান্দাহ যখন আল্লাহ্‌র অলী বা বন্ধু হয়ে যাবে তখন তার কোন দু‘আ রাব্বুল ‘আলামীন; মহান আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করবেন না বা ফিরিয়ে দেবেন না।

আর কেউ যদি ওয়ালায়াতের বা আল্লাহ্‌র বন্ধুত্ব লাভের এই দুই স্তরের কোন স্তরে উন্নিত হতে না পারে, সে যদি আল্লাহ্‌র আদেশকৃত অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং আল্লাহ্‌র নিষেধকৃত অবশ্য বর্জনীয় বিষয়গুলো যথাযথভাবে বর্জন করতে না পারে, তবে তার এইসব ত্রুটি বিচ্যুতি যদি কুফ্‌রের (আল্লাহ্‌কে অস্বীকার করার) পর্যায়ে না যায়, তাহলে সে “মুছলিম যালিম লি—নাফছিহী”অর্থাৎ নিজের প্রতি অন্যায়-অত্যাচারকারী মুছলিম বলে গণ্য হবে। ক্বিয়ামাতের দিন তাকে আল্লাহ্‌র শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে কেবল পাপ থেকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করার জন্য। অতঃপর (শাস্তি ভোগের পর) তার শেষ গন্তব্য হবে জান্নাত; সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

পক্ষান্তরে মুক্বতাসিদূন ও ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত – এই দুই স্তরের লোকেরা কোন রকম হিসাব-নিকাশ ও শাস্তিভোগ ব্যতীত তাদের প্রথম যাত্রাই হবে জান্নাতে এবং তা হবে চিরকালের জন্য।
এই তিন প্রকার লোকের কথা আল্লাহ 0 ক্বোরআনে কারীমে একসাথে একটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:-

ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللهِ ذٰلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيْرُ. جَنَّاتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا يُحَلَّوْنَ فِيْهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَّلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيْهَا حَرِيْرٌ.

অর্থাৎ— অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাহ্দের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি, তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্‌র নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে অগ্রগামী। এটাই হলো বিরাট অনুগ্রহ। তারা প্রবেশ করবে বসবাসের জান্নাতে। তথায় তারা স্বর্ণনির্মিত মোতি খচিত চিরুণী দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পোষাক হবে রেশমের। ((ছূরা ফাত্বির— ৩২—৩৩))

উক্ত আয়াতে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:—

جَنَّاتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا

অর্থাৎ— বসবাসের জান্নাতে তারা প্রবেশ করবে।

এখানে সাধারণভাবে “তারা”বলতে আয়াতে উল্লেখিত তিন প্রকারের লোককেই বুঝানো হয়েছে। যালিম লি—নাফছিহী, মুক্বতাসিদ এবং ছাবিক্ব ফিল খাইরাত— এই তিন প্রকার লোকই বসবাসের জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে মুক্বতাসিদ এবং ছাবিক্ব ফিল খাইরাত— এই দুই প্রকার লোক হিসাব—নিকাশ ছাড়া এবং কোনরূপ শাস্তিভোগ ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আর যে ব্যক্তি কুফ্‌র ব্যতীত আল্লাহ্‌র নাফরমানী এবং পাপ ও অসৎকর্ম সম্পাদনের দ্বারা নিজের প্রতি অন্যায়—অত্যাচার করবে, তারও শেষ ঠিকানা হবে জান্নাত, তবে এর আগে শাস্তিভোগের মাধ্যমে তাকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ হতে হবে। তাই প্রথমে যদিও তাকে জাহান্নামে যেতে হবে তবে সেখানে তাকে আজীবন থাকতে হবে না, বরং জাহান্নামে শাস্তিভোগের পর যখন সে পাপমুক্ত হয়ে যাবে তখন তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হবে এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর তখন থেকে জান্নাতই হবে তার চিরস্থায়ী আবাসস্থল।

একজন মূমিন যখন ঈমান—‘আক্বীদাহ সম্পর্কিত এসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলো জানবে এবং অনুধাবন করবে, তখন তার অন্তর আন্দোলিত হয়ে উঠবে। আল্লাহ্‌র নিকট উচ্চ স্তর ও মর্যাদা লাভের জন্য তার অন্তরে পরম আগ্রহ—উদ্দীপনা তৈরি হবে (সে ছাবিক্ব ফিল খাইরাত হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে)।
আমরা আমাদের মহান পালনকর্তা আল্লাহ্‌র (0) নিকট; যার কোন অংশীদার বা শরীক নেই, যার হাতে সকল কিছুর কতৃর্ত্ব ও নিয়ন্ত্রণ, যিনি হলেন তাওফীক্ব দানের(আমাদেরকে সৎকর্ম সম্পাদনের এবং অসৎকর্ম থেকে বেঁচে থাকার শক্তি—সামর্থ্য দানের)মালিক, তাঁর কাছে কামনা ও প্রত্যাশা করছি— তিনি যেন আমাদের সকলের কেশগুচ্ছ ধরে কল্যাণের পথে টেনে নিয়ে যান, তিনি যেন আমাদের প্রত্যেকের অবস্থা সংশোধন করে দেন, আমাদেরকে যেন তাঁর সরল—সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং চোঁখের এক পলকের (এক মুহূর্তের) জন্যও যেন তিনি আমাদেরকে আমাদের নিজেদের উপর ছেড়ে না দেন।

এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তা হলো, প্রত্যেক মুছলিমের অবশ্যই উচিত- (সে যতই আল্লাহ্‌র আনুগত্য মূলক কাজকর্ম তথা ‘ইবাদাত – বন্দেগী করুক না কেন) নিজেকে সাধু ও পুতঃপবিত্র দাবি করা থেকে সতর্ক ও সাবধান থাকা। এ সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 ইরশাদ করেছেন:-

فَلَا تُزَكُّوا أَنفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَىٰ 

অর্থাৎ- তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা দাবি করো না। তিনিই ভালো জানেন- কে তাক্বওয়া অবলম্বনকারী।ছূরা আন্‌নাজ্‌ম— ৩২

আল্লাহ্‌র অলী হওয়া বা তাঁর বন্ধুত্ব লাভের বিষয়টি এরূপ কোন বিষয় নয়, যা কেউ নিজে নিজের জন্যে দাবী করতে পারে। যারা একাজটি করে থাকে (অর্থাৎ, যারা নিজে নিজেকে আল্লাহ্‌র অলী, দরবেশ, বযুর্গ, সূফী-সাধক, পীরে কামিল ইত্যাদি বলে দাবী করে থাকে) তারা মূলত অন্যায় ও বাতিল উপায়ে মানুষের সম্পদ ভক্ষণের নিমিত্ত কিংবা আল্লাহ্‌র বান্দাহ্‌দের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের হীন উদ্দেশ্যে অথবা সমাজে কথিত সুনাম ও সাময়িক খ্যাতি লাভের জন্য এরূপ করে থাকে। অতএব সাবধান! (এ ধরনের লোক থেকে এবং এরূপ কর্মকান্ড থেকে)!
মূলত ওয়ালায়াত বা আল্লাহ্‌র অলী হওয়া- এটি একজন মূমিন বান্দাহ ও আল্লাহ্‌র (0) মধ্যকার বিষয়। একজন প্রকৃত মূমিন আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভের আশায় আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ ও তাঁর অলী হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। তাই সত্যিকার অর্থে যিনি আল্লাহ্‌র অলী হয়ে থাকেন তিনি কখনোই নিজেকে আল্লাহ্‌র অলী বলে দাবি করেন না, বা করতে পারেন না। তিনি বরং সবসময় নিজেকে আল্লাহ্‌র নিকট পাপী, অপরাধী ও যথাযথভাবে আল্লাহ্‌র (0) হাক্ব আদায় করতে পারছেন না বলে মনে করে থাকেন।
ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 0 তার পরিপূর্ণ মু’মিন বান্দাহ্‌দের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন:—

وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلٰى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ

অর্থাৎ— আর যারা যা দেয়ার তা ভীত কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে দেয় যে, তারা তাদের পালনকর্তার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে।ছূরা মূমিনূন— ৬০

এ আয়াত দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মূমিন; ছাবিক্ব ফিল খাইরাত বা কল্যাণের কাজে অগ্রগামী হলেন তারা, যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্যমূলক যা কিছু করার সবকিছুই করে থাকেন অথচ তাদের অন্তর সব সময় এই ভয়ে ভীত থাকে যে, যদি তাদের ‘আমাল সমূহ আল্লাহ 0 ক্বাবূল না করেন।
আবুদ্‌ দারদা 3 বলেছেন:-

لَأَنْ أَسْتَيْقِنَ أَنَّ اللهَ تَقَبَّلَ مِنِّيْ صَلَاةً وَاحِدَةً أَحَبُّ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا

অর্থ- আমার একটি সালাত আল্লাহ ক্বাবূল করেছেন, নিশ্চিতভাবে একথাটি জানা আমার কাছে সমগ্র দুন্‌ইয়া এবং তাতে যা কিছু আছে এসব থেকে অধিকতর পছন্দনীয়। (ছূরা আল মা-ইদাহ এর ২৭নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর o এই আছারটি বর্ণনা করেছেন)
হাছান বাসারী o বলেছেন:-

إِنَّ الْمُؤْمِنَ جَمَعَ إِحْسَانًا وَشَفَقَةً ، وَإِنَّ الْمُنَافِقَ جَمَعَ إِسَاءَةً وَأَمْنًا

অর্থ- মূমিনের মধ্যে দু’টি বিষয় একসাথে থাকে। সে ভালো কাজ করে এবং ভয়ে থাকে (এই ভয়ে যে, আল্লাহ 0 তার এই ‘আমাল ক্বাবূল করলেন কি-না)। আর মুনাফিক্বের মধ্যেও দু‘টি বিষয় একসাথে থাকে – সে মন্দ কাজ করে এবং নিশ্চিন্ত থাকে (আল্লাহ্‌র ‘আযাবের ভয় তার মধ্যে থাকে না)।ছূরা আল মূমিনূনের ৫৭—৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফছীরু ইবনি কাছীর ও তাফছীরুত ত্বাবারী— ১৭/৬৮

‘আব্দুল্লাহ ইবনু আবী মুলাইকাহ o বলেছেন:—

أَدْرَكْتُ ثَلَاثِيْنَ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّهُمْ يَخَافُ النِّفَاقَ عَلٰى نَفْسِهِ

অর্থ- আমি ত্রিশজনের অধিক রাছূলুল্লাহ 1 এর সাহাবীদের পেয়েছি, যাদের প্রত্যেকে নিজের ব্যাপারে নিফাক্বের (মুনাফিক্বির) ভয় করতেন। অর্থাৎ এই ভয় করতেন যে, তার দ্বারা মুনাফিক্বী হয়ে গেল কি—না।
((সহীহ বুখারী তা‘লীক্ব- কিতাবুল ঈমান))

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যাবতীয় অবস্থা সংশোধন করে দেন, আমাদেরকে আমাদের নিজেদের উপর চোঁখের এক পলকের জন্য (এক মুহূর্তের জন্য) ছেড়ে দেবেন না। হে আমাদের মা‘বূদ! আমাদেরকে কেবল দাবি আর ধারণা নয় বরং সত্যিকার অর্থে যথার্থভাবে নিজেদের মধ্যে ঈমান বাস্তবায়ন করার তাওফীক্ব দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমাদেরকে আমাদের নিজেদের উপর এক মুহূর্তের জন্য নির্ভরশীল করবেন না।

সালাত ও ছালাম বর্ষিত হোক অলীগণের ইমাম ও মুত্তাক্বীগণের ছরদার মুহাম্মাদ ইবনু ‘আব্দিল্লাহ্‌-র প্রতি এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবাগণের প্রতি।


১. ছূরা ইঊনুছ -৬২-৬৩ 
২. সাহীহুল বুখারী 
৩. ছূরা আন্‌নাজ্‌ম— ৩২ 
৪. ছূরা মূমিনূন— ৬০ 
৫. ছূরা আল মূমিনূনের ৫৭—৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফছীরু ইবনি কাছীর ও তাফছীরুত ত্বাবারী— ১৭/৬৮ 

Subscribe to our mailing list

* indicates required
Close