ইমাম আল আওযা‘য়ী বলেছেন:- “ তুমি অবশ্যই ছালাফে সালিহীনের বর্ণনা ও কথা-বার্তাকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করো যদিও মানুষ তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে। অন্যান্য মানুষের রায় বা অভিমত তা যতই সুন্দর ও সাজানো গুছানো হোক না কেন, তথাপি তুমি তা গ্রহণ ও অনুসরণ থেকে পূর্ণ সাবধান ও দূরে থেকো। তাহলে এক পর্যায়ে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে যাবে যে, তুমি যে পথের উপর রয়েছ সেটাই হলো সরল সঠিক পথ”।আল মাদখাল লিল ইমাম আল বায়হাক্বী, পৃষ্ঠা নং- ২৩৩। শারাফু আসহাবিল হাদীছ লিল খতীব আল বাগদাদী, পৃষ্ঠা নং- ৬। জামি‘উ বয়ানিল ‘ইল্ম লি ইবনে ‘আব্দিল বার্, ভলিয়ম নং ১, পৃষ্ঠা নং- ১৭০১। এবং আশ্শারী‘আহ লিল আ-জুরী, পৃষ্ঠা নং- ১১৯।
নিশ্চয়ই আল্লাহ 7 রাছূল মুহাম্মাদকে (1) এমন এক সময় প্রেরণ করেছিলেন, যখন মানব জাতি চরম অজ্ঞতা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। যখন তাদের মধ্যে এক সুদীর্ঘ সময় আল্লাহ প্রেরিত কোন নাবী-রাছূলের আগমন ঘটেনি। মানুষ যখন চরম দ্বন্ধ-সংঘাতে পরস্পর বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যখন তারা তাদের দ্বীন সম্পর্কে কিছুই জানত না, বরং ধর্মীয় বিষয়ে তাদের দালীল-প্রমাণ ছিল একমাত্র তারাই; যাদেরকে তারা আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য তথা মা‘বুদ সাব্যস্ত করে নিয়েছিল।
এ সম্পর্কে ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 8 ইরশাদ করেছেন:-
بَلْ قَالُوا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِم مُّهْتَدُونَ. سورة الزخرف- ٢٢
অর্থাৎ- বরং তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে পেয়েছি এক পথের অনুসারী এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণকারী।ছূরা আয্যুখরুফ- ২২
যখন মানুষ নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদ নিরসনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের রায় ও ফায়সালার উপর এবং এমন কতক বিধি-বিধানের উপর নির্ভর করতো, যে সম্পর্কে আল্লাহ কোন ছনদ বা প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি; যে রায় বা বিধানের কোনরূপ গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহ্র কাছে নেই। এমতাবস্থায় আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাঁর রাছূল মুহাম্মাদকে পাঠিয়ে দিশেহারা, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট মানুষকে হিদায়াত তথা সঠিক পথের দিশা দান করলেন। আল্লাহ 0 তাঁর রাছূলের (1) মাধ্যমে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন, দ্বন্ধ-সংঘাত আর রক্তের হুলিখেলায় মত্ত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। যার ফলে মানুষ এই দ্বীনে ইছলামের সুশীতল ছায়াতলে খাঁটি তাওহীদী ‘আকীদাহ-বিশ্বাস নিয়ে শান্তিময় জীবন যাপন করতে শুরু করল। তারা এক আল্লাহ্র (b) ‘ইবাদাত করতে লাগল। ইছলামের হিদায়াত লাভের পর তারা আল্লাহ 7 ব্যতীত আর কাউকে ভয় পেত না। নিজেদের দ্বীনী ও দুন্ইয়াওয়ী বিষয়ে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাছুলের বিধান ও ফায়সালা ব্যতীত অন্য কারো বিধান বা ফায়সালার আশ্রয় গ্রহণ করতো না। এই উম্মাতের জন্য আল্লাহ 0 প্রবর্তিত বিধি-বিধান রাছূলের (1) প্রতি “ক্বোরআন” ও “ছুন্নাহ” এ দু’প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নাযিল হতো। রাছূল 1 নিজের খেয়াল-খুশিমতো কিছু বলতেন না। বরং অহীর মাধ্যমে তাঁর প্রতি যা নাযিল হতো, তিনি শুধু তা-ই বলতেন। আল্লাহ 0 স্বীয় নাবীকে ততক্ষণ পর্যন্ত দুন্ইয়া থেকে বিদায় দেননি, যতক্ষণ তিনি (আল্লাহ 7) মানবজাতির জন্যে দ্বীনে ইছলামকে পরিপূর্ণ ও সম্পন্ন করেননি।
ইছলামকে পরিপূর্ণ ও সম্পন্ন করে দেয়ার পর রাছূল এর ওফাতের মাত্র কয়েকমাস পূর্বে তাঁর বিদায় হাজ্জের সময় আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন:-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا.سورة المائدة- ٣
অর্থাৎ- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নি‘মাত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইছলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।ছূরা আল মা-য়িদাহ- ৩
দ্বীনে ইছলামের পূর্ণতা ও চূড়ান্ততা প্রাপ্তি হলো এই উম্মাতের প্রতি আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের এক সুমহান নি‘মাত, যা তিনি এই আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। মুছ্লমান জাতি উল্লেখিত সুমহান আয়াতের অধিকারী ও দাবিদার হওয়ার কারণেই ইয়াহুদীরা মুছলমানদের প্রতি হিংসা পোষণ করে থাকে। এ সম্পর্কে সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিমে ‘উমার 3 হতে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, তিনি বলেন- এক ইয়াহুদী ব্যক্তি বলল-
يَا أَمِيرَ المُؤْمِنِينَ، آيَةٌ فِي كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا، لَوْ عَلَيْنَا مَعْشَرَ اليَهُودِ نَزَلَتْ، لاَتَّخَذْنَا ذَلِكَ اليَوْمَ عِيدًا. قَالَ: أَيُّ آيَةٍ؟ قَالَ: اليَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا.متفق عليه
অর্থ- হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনাদের কিতাবে (আল ক্বোরআনে) এমন একটি আয়াত রয়েছে, যে আয়াতটি আপনারা পাঠ করে থাকেন, যদি সে আয়াত আমরা ইয়াহুদী জাতির প্রতি নাযিল হতো, তাহলে এ আয়াত নাযিলের দিনটিকে আমরা ‘ঈদের দিন বলে গণ্য করতাম। ‘উমার 3 লোকটিকে বললেন- তুমি কোন আয়াতের কথা বলছো? লোকটি বললো- সে আয়াতটি হলো-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا.সাহীহ্ বুখারী ও সাহীহ্ মুছলিম
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে ‘আব্বাছ h বলেছেন- এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাঁর নাবী এবং মু’মিনদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীন তথা জীবন বিধানকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। তাই কখনো তাতে আর কোনকিছু সংযুক্ত বা বৃদ্ধিকরণের আদৌ প্রয়োজন হবে না। এবং যেহেতু তিনি ইছলামকে সুসম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত করে দিয়েছেন, সুতরাং তিনি তা থেকে বিন্দুমাত্র কিছু হ্রাস বা বিয়োজন করবেন না এবং যেহেতু তিনি ইছলামকে আমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে (চূড়ান্তভাবে) পছন্দ ও মনোনীত করেছেন, তাই তিনি আর কখনো সেটাকে অপছন্দ (বাতিল) করবেন না।দেখুন! তাফছীরে ইবনে কাছীর, ভলিয়ম নং- ২, পৃষ্ঠা নং- ১২
এমনিভাবে রাছূল অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর উম্মাতকে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট পথের উপর রেখে গেছেন। একমাত্র অনিবার্য ধ্বংসশীল ব্যতীত আর কেউই এই সরল-সঠিক, সুস্পষ্ট পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।
এ সম্পর্কে আবুদ্ দারদা থেকে বর্ণিত হাদীছে রয়েছে, রাছূল 1 বলেছেন:-
وَايْمُ اللَّهِ، لَقَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى مِثْلِ الْبَيْضَاءِ، لَيْلُهَا وَنَهَارُهَا سَوَاءٌ.سنن إبن ماجه, السنة لإبن أبي عاصم
অর্থাৎ- আল্লাহ্র শপথ, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ধবধবে সাদা বস্তুর মত সুস্পষ্ট দ্বীনের উপর রেখে গেলাম, যার দিবা-রাত্রি সমান (অর্থাৎ তাতে অস্পষ্টতা ও অন্ধকার বলতে কিছু নেই)।ছুনানু ইবনে মাজাহ। আছ্ছুন্নাহ লি ইবনে আবী ‘আসিম
হাদীছটি বর্ণনা করার পর আবুদ্ দারদা বলেছেন- সত্যিই আল্লাহ্র ক্বছম! রাছূল আমাদেরকে ধবধবে উজ্জল, সাদা এমন এক প্রামাণ্য দ্বীনের উপর রেখে গেছেন, যার মধ্যে দিবা-রাত্রি সমান (অর্থাৎ যে দ্বীন তথা ধর্মের যাবতীয় বিষয় দিবালোকের মত সুস্পষ্ট-সমুজ্জ্বল)।
এতদ্বিষয়ে অনুরূপ একটি হাদীছ ‘ইরবায ইবনু ছারিয়াহ 3 রাছূল 1 থেকে বর্ণনা করেছেন।
যেহেতু একথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত যে, দ্বীন ইছলাম পূর্ণাঙ্গ-পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হয়ে গেছে, সুতরাং ইছলাম বহির্ভূত কোন বিষয় ইছলামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা, কিংবা আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের নির্দেশিত ও র্নিধারিত পথ-পন্থা ও পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কোন পথ-পন্থা ও পদ্ধতিতে আল্লাহ্র ‘ইবাদাত করা কোন মুছলমানের জন্য জায়িয নয়।
বরং প্রত্যেক মুছলমানের অবশ্য কর্তব্য হলো আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য করা, সাথে সাথে ক্বোরআন ও ছুন্নাহ্র অনুসরণ করা এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন পথ, প্রথা বা পদ্ধতি (তা যত সুন্দরই মনে হোক না কেন, কিংবা যত সুন্দর করেই তা উপস্থাপন করা হোক না কেন) প্রবর্তন না করা। কেননা দ্বীন পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তাই এখন আর দ্বীন বহির্ভূত কোন বিষয়-বস্তু, বাহ্যত: যত ভালো মনে হোক না কেন, তথাপি তা দ্বীন বলে গণ্য হবে না, বরং সেটা হবে বিদ‘আত, বিভ্রান্তি ও বিপথগামীতা। যেমন- ক্বোরআনে কারীমে আল্লাহ 7 ইরশাদ করেছেন:-
فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلاَّ الضَّلاَلُ.سورة يونس- ٣٢
অর্থাৎ- সত্যের পরে গুমরাহী ব্যতীত আর কি থাকতে পারে?ছূরা ইউনুছ- ৩২